গণতন্ত্রের বৈধতা দিতে গিয়ে অনেক ইসলামপন্থি ভাই বলেন এটা হল ‘মন্দের ভালো’। কিন্তু সমস্যা হল, Lesser of two evils – বা মন্দের ভালো নীতির অনুসরনের অবশ্যম্ভাবী রেসাল্ট দীর্ঘ মেয়াদে সমাজে, রাষ্ট্রে, বিশ্বে মন্দ বা evil বৃদ্ধি পাওয়া। সিম্পল গেইম থিওরি দিয়ে এটা ম্যাথমেটিকালি প্রমান করা সম্ভব। আমরা যদি সবসময় মন্দের ভালো – কেই বেছে নেয়ার মূলনীতি নেই তাহলে বাই ডেফিনিশান আমরা সবসময় মন্দকে বেছে নিচ্ছি।
এই নীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এটা প্রতিটা প্রেক্ষাপটকে একটা নির্দিষ্ট বাইনারি চয়েসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। হয় আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি। হয় গণতন্ত্র নয় সমাজতন্ত্র। হয় অ্যামেরিকা নইলে রাশিয়া, হয় রাজাকার নাহয় ভাদা…
গণতন্ত্র, ব্যাংকিং, লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি, লাইফ ইনশুরেন্স, মিউযিক, এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিসহ বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন মন্দকে ইসলামাইয করার প্রবণতার (যার সবচেয়ে নগ্ন ও কুৎসিত ম্যানিফেস্টেইশান হল পশ্চিমা মডারেট “ইসলাম) আদর্শিক ভিত্তি হল “মন্দের ভালো” গ্রহনের এই নীতি। গণতন্ত্র, ব্যাঙ্কিং, চ্যারিটি, পাবলিক স্পিকিং, মোটিভেইশানাল স্পিকিং, স্কুল, ক্রিটিকাল থিংকিং, পররাষ্ট্র নীতি, টক শো – যা কিছু আছে সব কিছুকে একটা ইসলামী ফ্লেভার দিয়ে দিলেই হল। ফ্লেভার দেয়ার ক্ষেত্রে শারীয়াহর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা হবে যতোটুকু অনুসরণের সু্যোগ বর্তমান সিস্টেম দেয়।
আর বাকিটা?
বাকিটার জন্য আমি জিজ্ঞাসিত হবো না। আমি “সাধ্যমত চেষ্টা” করেছি।
“মন্দের ভালো”র নীতির ওপর ভর করে ইসলামাইযেইশানের দিকে আহবানকারীরা এ যুক্তিগুলো দেয়ার সময় “সাধ্যমত চেষ্টা” বলতে বোঝান সিস্টেম বা বিদ্যমান ব্যবস্থা যতোটুক অ্যালাও করে ততোটুক চেষ্টা করুন। এখানে “আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করছি”-র বদলে কথাটা আসলে হওয়া উচিত “আপনি আপনার সুবিধামতো চেষ্টা করুন।” আর বাস্তবে এটাই হল ইসলামাইযেইশান। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যতোটুকু ইসলাম মেনে নেবে আমি ততোটুকুর ভেতরে থেকে ইসলাম পালন করবো। সিম্পলের মধ্যে সুন্দর!
সুবিধা, কুফফারের অনুমোদন, বিদ্যমান কাঠামোর অনুকরন-অনুসরণ আর আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে সমন্বয় করে সবকিছুর শুরুতে “ইসলামী” ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার যে ইসলামাইযেইশানের নীতি তার সাথে আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জালের শারীয়াহর আকাশ পাতাল পার্থক্য। শারীয়াহর অবস্থান হলো দ্বীনের কোন একটি হুকুম বা অবস্থানের সাথে কম্প্রোমাইয না করা, প্রয়োজনে দুনিয়ার সাথে কম্প্রোমাইয করা।
মুসলিমদের দায়িত্ব হল নিজেদের জীবনকে শারীয়াহ-কমপ্লায়েন্ট করা।
ইসলামাইযেইশানের লক্ষ্য থাকে দ্বীনকে দুনিয়া কমপ্লায়েন্ট করা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল আমাদের সাধ্যমত যে চেষ্টা করার কথা, সেটা আমরা কার পদ্ধতিতে করবো? আল্লাহ-র রাসূলের ﷺ দেখানো পদ্ধতিতে? নাকি লিঙ্কন, মার্ক্স, গান্ধী, অ্যাডাম স্মিথ কিংবা কেইন্সের পদ্ধতিতে?
শার’ই পদ্ধতি থাকা অবস্থায় সেটাকে ছেড়ে অন্য একটি পদ্ধতি গ্রহণ করে তারপর সেটাকে ইসলামীকরন করে সেটাকে দ্বীন দাবি করা, সেটার ভিত্তিতে হাশরের ময়দানে প্রশ্নোত্তরে পাশ মার্ক আশা করা কতোটা যৌক্তিক?
কিন্তু ইসলামাইযেইশানের নীতি বলছে -যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এটা সম্ভব না, ওটা রিয়ালিস্টিক না – তাই আমাদের কাজ হলো যথাসাধ্য চেষ্টা করা এবং সাধ্যমত চেষ্টার দ্বারা শারীয়াহর যতোটা কাছাকাছি থাকা যায়, সে চেষ্টা করা। এখানে অগ্রাধিকার কোনটা পাচ্ছে? শারীয়াহ নাকি নিজের সুবিধা? এখানে শারীয়াহর আবশ্যকতার চাইতে প্র্যাগম্যাটিযম বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। নিশ্চিত ভাবেই শারীয়াহ আর ইসলামীকরন এক না।
সবচেয়ে ড্যামেজিং বিষয়টা হল যারা ইসলামাইযেইশানের ধারণার প্রবক্তা ছিলেন তারা সরাসরি স্বীকার করতেন যে ইসলামাইযেইশান কোন চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হতে পারে না, মূল উদ্দেশ্যও হতে পারে না। বরং এটা হল একটা সাময়িক সমাধান – necessary evil – এই মুহুর্তে আর কিছু করা যাচ্ছে না দেখে এটা করা হচ্ছে। কিন্তু আজকে ইসলামাইযেইশানের পক্ষের তাত্ত্বিকদের অনেকেই এটাকেই মূল উদ্দেশ্য এবং সমাধান মনে করছেন। যেমন আরবের ইখওয়ানুল মুসলিমীন, উপমহাদেশের জামায়াতে ইসলামী এবং পশ্চিমের মডারেট ইসলামিস্টদের তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক গুরু ইউসুফ ক্বারদাওয়ি ৭০-এর দশকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলেছিল প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে – necessary evil – হিসেবে। কিন্তু কয়েক দশক পর সেই একই লোক গণতন্ত্রকেই প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছে।
ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মুশরিক পরিবেষ্টিত অবস্থায় মন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভেঙ্গেছেন – আল্লাহর রাসূল ﷺ কাবার সামনে একাকী মুশরিকদের সামনে গিয়ে বলেছেন – আমি তোমাদের জন্য জবাই নিয়ে এসেছি [মুসনাদ আহমাদ]। যদি ইসলামাইযেইশানের নীতি শারীয়াহ সম্মত হত, তাহলে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, হুদ আলাইহিস সালাম, সালিহ আলাইহিস সালাম পারতেন ক্ষমতাশালী হওয়া পর্যন্ত সুবিধামতো চেষ্টা করে তারপর এক পর্যায়ে গিয়ে পুরো শারীয়াহ মানার। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ পারতেন ক্বুরাইশদের অফার মেনে শাসক হতে, অর্থ সম্পদ এবং ক্ষমতার মালিক হতে অথবা দারুন নাদওয়াহতে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু তাঁরা এই নীতি গ্রহণ করেননি, আলাইহিমুস সালাম । কারণ আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জালের কাছে এই নীতির বৈধতা নেই।
যারা ইসলামাইযেইশানের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথার বলেন তাদের অনেকেই আন্তরিকভাবেই এ পদ্ধতিতে বিশ্বাস করেন। কিন্তু আন্তরিকতা আর ইখলাসের কারণে ভুল শুদ্ধ হয়ে যায় না। যতোক্ষণ পর্যন্ত আরেকজনের ঠিক করে দেয়া বাইনারি কাঠামোর ভেতরে থেকে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য ততোক্ষণ – আপনি নিজে যাই মনে করুন না কেন – বাস্তবতা হল, আপনি পরাধীন। যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজের মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে আরেকজনের মূলনীতিকে অনুসরন করবেন ততোক্ষণ আপনি অন্যের আদর্শের অনুসরনই করছেন। আপনি সেটার উপর যতো বড়, সুন্দর এবং ইন্ট্রিকেইট ডিযাইনের “ইসলামী” সাইনবোর্ড লাগান না কেন – এই বাস্তবতা বদলাবে না।
যতোক্ষণ মূল অসুখের চিকিৎসা করা হবে না, ততোক্ষণ সিম্পটম নিয়ে যতোই চিৎকার-চেচামেচি করুন না কেন লাভ নেই।