ধরুন সাদা পাঞ্জাবি পরে আপনি কারও জানাযায় গেছেন। আপনার পোশাক নিয়ে শুনতে পেলেন দুজনের মন্তব্য।
প্রথমজন বলল, ও সাদা পাঞ্জাবি পরে এসেছে।
দ্বিতীয়জন বলল, ও কালো পাঞ্জাবি পরে এলে ভালো হতো।
এ দুই মন্তব্যের মধ্যে পার্থক্য কী? অনেক ধরনের পার্থক্যই আছে, তবে আমরা মৌলিক একটা পার্থক্যের ওপর ফোকাস করব।
প্রথমজনের কথা একটা statement of fact, সে জাস্ট একটা তথ্য জানাচ্ছে। নিরেট ইনফরমেইশান। এর সাথে আর কোনো কিছু যোগ করা হয়নি। দ্বিতীয়জনের বক্তব্য হলো তার ব্যক্তিগত মত, কোনো ফ্যাক্ট না। জানাযাতে সাদার বদলে কালো পরা কি আসলেই ভালো? কালোই কি বেস্ট চয়েস, নাকি রংটা অফ-ওয়াইট, নীল বা অন্য কিছু হতে পারে?
এ ধরনের প্রশ্নের অনেক রকমের উত্তর হতে পারে। একেকজনের কাছে ভালো লাগতে পারে একেক রং। কিন্তু দ্বিতীয়জনের এ বক্তব্য কোনো নিরেট তথ্য না। অনেক মতের মধ্যে একটা মত কেবল। প্রথমজনের বক্তব্য একটা পযিটিভ স্টেইটমেন্ট। দ্বিতীয়জনের বক্তব্য নরম্যাটিভ। যে বক্তব্য শুধু কোনো বাস্তব সত্য বা তথ্যকে তুলে ধরে সেটা পযিটিভ (positive)। অন্যদিকে নরম্যাটিভ (normative) বক্তব্য হলো যা নির্দিষ্ট মত (যেমন ঔচিত্য) বা নৈতিকতা প্রকাশ করে।
এ পার্থক্যটা মাথায় রাখুন।
২.
লক্ষ করবেন ইসলামের সাদা, কালো এবং এ দুয়ের মাঝের অন্য সব রঙের চামড়ার সমালোচকরা ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্টে ফিরে আসে। এ মূল পয়েন্টগুলোর শেকড় থেকে বের হয়ে আসা বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার দিকে যায় ইসলামের বিরুদ্ধে তোলা তাদের আপত্তিগুলো। এ শাখা-প্রশাখাগুলোর অনেকগুলোই আপনার চেনা। যেমন :
‘ইসলামে নারীকে পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার দেয়া হয় না,
ইসলামে বাক্স্বাধীনতা নেই,
সমকামীদের প্রতি ইসলামের অবস্থান উগ্র,
ইসলাম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয় না,
ইসলাম ধর্মের স্বাধীনতা দেয় না,
ইসলাম সাম্প্রদায়িক,
ইসলামের অনেক বিধিবিধান অমানবিক,
নারী-পুরুষের মেলামেশা ও যৌনতার ব্যাপারে ইসলামের ধারণা সেকেলে,
ইসলাম সহিংসতাকে সমর্থন করে’, ইত্যাদি।
কাফিরদের মধ্যে যারা ইসলামের সমালোচনা করে অথবা মুসলিম পরিবারের জন্ম নিয়ে যারা নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী অথবা ইসলামবিদ্বেষী হয়, ইসলাম মানার ব্যাপারে তাদের অস্বস্তি, আপত্তি ও অভিযোগের বিশাল একটা অংশ দেখবেন ঘুরপাক খায় এগুলোর মধ্যে। এমনই কোনো চিন্তাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় অনেকের সংশয় কিংবা বিদ্রোহের।
অন্যদিকে এ অভিযোগগুলো করা হলে মুসলিমদের মধ্যে অনেকে ব্যস্ত হয়ে যান ইসলামেও নারী অধিকার আছে, ইসলাম সবচেয়ে মানবিক ধর্ম, ইসলাম মানে শান্তি, ইসলাম সবচেয়ে সহনশীল ইত্যাদি প্রমাণে।
কিন্তু এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার, যেটা আমরা কেউ দিই না বললেই চলে।
সেটা কী?
দেখুন এই যে সমালোচনাগুলো করা হচ্ছে এগুলোর প্রতিটির পেছনে কাজ করছে ভালো-মন্দের একটি নির্দিষ্ট ধারণা। এ আপত্তিগুলো তোলা হচ্ছে নৈতিকতার একটি নির্দিষ্ট ফ্রেইমওয়ার্ক থেকে।
আচ্ছা বলুন তো,
নারীকে পুরুষের সমান অধিকার কেন দিতে হবে? কেন সমকামিতাকে বিকৃতি মনে না করে বরং সমকামীদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে হবে? কেন একজন মুসলিম আর একজন কাফিরকে সমান মনে করতে হবে? নারীপুরুষের যৌনতার ব্যাপারে বর্তমান পৃথিবী যে অবস্থান গ্রহণ করেছে কেন সেটাকে ঠিক মনে করতে হবে?
কেন এটা খারাপ আর ওটা ভালো?
কিসের ভিত্তিতে?
কোন মাপকাঠি অনুযায়ী?
বিজ্ঞান? ওপরের একটা প্রশ্নের সাথেও বিজ্ঞানের কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে নিরেট তথ্য কিংবা বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞান আপনাকে বলবে নারী এবং পুরুষের মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যপ্রণালি ভিন্ন যা তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য উপযোগী করে তোলে।[1] ইতিহাস আপনাকে বলবে যুদ্ধ রাষ্ট্রের নামে হয়, দর্শনের নামে হয়, স্বার্থের জন্য হয়, গায়ের রঙের জন্যও হয়। যখনই দুদল মানুষের মধ্যেকার মতবিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায় না এবং এক বা উভয়পক্ষ মতবিরোধকে মেনে নিয়ে সহাবস্থান করতে চায় না, তখন ফয়সালা হয় সংহিসতার মাধ্যমে। এটা মানব ইতিহাসের এক ধ্রুব সত্য।
বহুবিবাহ, সমকামিতা, ইসলামের দণ্ডবিধি–প্রতিটা আপত্তির ক্ষেত্রেই পাল্টা প্রশ্ন করা যায়।
কেন বহুবিবাহ খারাপ আর ‘সমকামী বিয়ে’ ভালো?
কেন মুরতাদের জন্য মৃতুদণ্ড বর্বর কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহীর জন্য মৃত্যুদণ্ড জায়েজ?
কেন আর যে কেউ শক্তি ব্যবহার করলে সেটা বেআইনি কিন্তু রাষ্ট্র করলে সেটা বৈধ?
কেন অ্যামেরিকা আর জাতিসংঘের সমর্থন পাওয়া সশস্ত্র দল ‘বিপ্লবী’ আর অন্য সবাই ‘জঙ্গি’ কিংবা ‘সন্ত্রাসী’?
এ রকম অনেক প্রশ্ন ওঠানো যায়। কেন এটা খারাপ আর ওটা ভালো? হতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেটাকে ভালো দাবি করা হচ্ছে সেটা আসলেই ভালো। কিন্তু এ ভালো-মন্দটা ঠিক করা হচ্ছে কীভাবে? কিসের ভিত্তিতে? বন্ধ ঘড়িও ২৪ ঘণ্টায় দুবার ঠিক সময় দেয়, তাই বলে বন্ধ ঘড়ির ওপর কিন্তু ভরসা করা যায় না।
আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো, এসব সমালোচনার পেছনে নৈতিকতার একটি নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। ভালোমন্দের একটি নির্দিষ্ট ধারণা থেকে এই উপসংহারগুলো বের হচ্ছে। প্রশ্ন হলো সেই ফ্রেইমওয়ার্কটা কী? সেই মতাদর্শটা কী?
লিবারেলিযম, সেক্যুলার হিউম্যানিযম। এনলাইটেনমেন্টের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। এ ফ্রেইমওয়ার্ক আমাদের যেসব উপসংহার দিচ্ছে সেগুলো নরম্যাটিভ, পযিটিভ না। আপনার কাছে মনে হতেই পারে যে জানাযার জন্য সবার গোলাপি রঙের ফতুয়া পরে আসা উচিত। কিন্তু আপনার মনে হওয়া আপনার মতকে সঠিক প্রমাণ করে না। দাবিকে সত্য বলতে হলে প্রমাণ লাগবে। সেক্যুলার হিউম্যানিযম বা লিবারেলিযমের উপসংহারগুলোকে ধ্রুব সত্য বলে আমার ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে যে, এটা নিছক আপনার মত না; বরং এটাই সত্য।
২+২ = ৪ এটা একটা বাস্তব সত্য। এটা অস্বীকার করা সম্ভব না।
কিন্তু ২+২ = ২২ হওয়া উচিত ছিল, এটা নিছক দাবি।
৩.
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ভালোমন্দের এই নির্দিষ্ট কাঠামো কেন আমি মেনে নিতে বাধ্য? কয়েক শ বছর আগে ইউরোপের ঔপনিবেশিক লুটেরারা নিজেরা নিজেরা ভেবে যে মানদণ্ড বানিয়েছে সেটা আমি মানব কেন? নাস্তিক-ইসলামবিদ্বেষীরা প্রশ্ন করে, ‘আমি স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নেব কেন?’ ‘কুরআনে আছে বলে আমাকে মানতে হবে কেন?’
অথচ এই একই স্ট্যান্ডার্ড তারা নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে না।
তুমি যেটাকে ভালো বলছ সেটাকে আমার ভালো বলে মেনে নিতে হবে কেন? তোমার দেয়া মানবাধিকার, অগ্রগতি আর উন্নতির সংজ্ঞাকেই কেন গ্রহণ করতে হবে? আমার কেন মানতে হবে তোমাদের ঠিক করা ভালোমন্দের কনসেপ্টকে? পুরো মানবজাতির ইতিহাস থেকে মাত্র দু-তিন শ বছরের অল্প একটা সময়কে আলাদা করে নিয়ে, সেই সময়ে গড়ে ওঠা ইউরোপের অল্প কিছু মানুষের চিন্তাভাবনা ও দর্শনকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেয়ার দাবি তুমি কীভাবে করো? তুমি চাও আমার পুরো দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি ‘সত্যের’ ইউরোপিয়ান ধারণার ওপর সাজাব? অথচ তোমার দাবিগুলোর পক্ষে কোনো প্রমাণই তোমার কাছে নেই?
এটা হলো পশ্চিমের চাপিয়ে দেয়া ন্যারেটিভের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার একটি। নিজেদের মতকে তারা বৈজ্ঞানিক কিংবা প্রাকৃতিক সত্য বলে দাবি করতে চায়। পশ্চিম আমাকে বলে বস্তুবাদী প্রমাণ ছাড়া স্রষ্টার আনুগত্য করা যাবে না, কিন্তু প্রমাণ ছাড়া মানুষের আনুগত্য করতে হবে। বিনা প্রশ্নে! দুঃখজনক বিষয়টা হলো পশ্চিমের এ দাবিগুলোকে নিজের অজান্তেই আমরা অনেকে সত্য বলে মেনে নিই। এগুলোকে সত্য ধরে নিয়ে এমনভাবে নিজেদের পরিচয় ও ইসলামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি যাতে তা মানুষের বানানো এই কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আমরা ইসলামকে যখন সমর্থন করি তখনো সেটা পশ্চিমের শেখানো ভাষায় করি। চেষ্টা করি সেক্যুলার হিউম্যানিযমের কাছে ইসলামকে উপাদেয় হিসেবে উপস্থাপনের। আর এটা, আমার মতে, আমাদের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়।
~চিন্তাপরাধ বইয়ে প্রকাশিত
[1] আগ্রহী পাঠক এ বিষয়ে দেখতে পারেন, Brain Sex: The Real Difference Between Men and Women, Anne Moir and David Jessel