দেশীয় মিডিয়ায় ট্র্যান্সজেন্ডারিসমের প্রচারণা


নিচের ছবিটা গত ৮ ই অগাস্ট (২০১৭) এ প্রকাশিত ডেইলি স্টারের সাপ্তাহিক ম্যাগাযিন লাইফস্টাইল থেকে নেওয়া। আমি ছবিটা ব্লার করে দিয়েছি। মূল লিঙ্কে অরিজিনাল ছবি আছে। ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে উনি একজন নারী, কিন্তু উনার মেইকাপ থেকে শুরু করে পোশাক পর্যন্ত সব এমনভাবে ঠিক করা হয়েছে যাতে করে উনার প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয় বোঝা না যায়। অর্থাৎ উনি যে একজন নারী তা বোঝা যায়। প্রশ্ন করতে পারেন “নারী” না বলে “প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়” – এর মতো কঠিন ফ্রেইয ব্যবহার করার কারন কী?

কারন হল, “Androgyny in a fair world” – নামের এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য নিছক ক্রসড্রেসিং (ছেলেরা মেয়েদের মতো পোষাক পড়া, ভাইসভারসা) জাতীয় কিছু প্রমোট করা না। বরং এ ধরনের আর্টিকেলের উদ্দেশ্য নারী পুরুষের লৈঙ্গিক পরিচয় সম্পর্কে স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে একটি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রমোট করা। এধরনের আর্টিকেলের উদ্দেশ্য মানুষের স্বাভাবিক লৈঙ্গিক পরিচয়ের বদলে Gender Confusion বা Gender Dysphoria প্রমোট করা।

Gender Confusion বা Gender Dysphoria বলতে কী বোঝায়? প্রাকৃতিক ভাবে আমরা মানুষের লৈঙ্গিক পরিচয় বাইনারী। কোন ব্যক্তি হয় পুরুষ অথবা নারী। এর পাশাপাশি অতি নগন্য সংখ্যক মানুষ থাকেন যাদের শরীরে একই সাথে নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গ থাকে। এধরনের মানুষদের বলা হয় True Hermaphrodite (Transsexual বা Transvestite না) বা Intersex. সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী প্রতি ২০০০ জনে ১ জন True Hermaphrodite ব্যক্তিকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ জনসংখ্যার ০.০৫%। অর্থাৎ মানুষের লৈঙ্গিক পরিচয় যে বাইনারী এটার প্রমাণ পৃথিবীর বাকি ৯৯.৯৫% মানুষ। কিন্তু আধুনিক সময়ের অতি আধুনিক মানুষের মধ্যে কিছু মানুষের হঠাৎ করে মনে হল, মানুষের পরিচয়ের ব্যাপারে এই “পুরনো প্যারাডাইম”-কে ভেঙ্গে এক নতুন প্যারাডাইম তৈরির চিন্তা করলো। তারা বলা শুরু করলো লৈঙ্গিক পরিচয় প্রাকৃতিক ভাবে নির্ধারিত কিছু না। মানুষ তার সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্যের ইত্যাদির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে নিজেকে হয় পুরুষ অথবা নারী হিসেবে চিহ্নিত করে। এটা নিজের বেছে নেয়ার ব্যাপার, পূর্বনির্ধারিত কিছু না। তাই এমন হতে পারে যে একজন মানুষ শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু তার ভেতরের ‘সত্তাটি’ নারীর। অথবা একজন মানুষ শারীরিকভাবে নারী কিন্তু তাদের ভেতরে পুরুষ সত্তার বসবাস। যখন এমনটা, অর্থাৎ ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ পরিচয় তার বাহ্যিক পরিচয়ের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক হয় তখন একে বলা হয় Gender Dysphoria। আবার এমনো হতে পারে যে একজন মানুষ শারীরিকভাবে যাই হোক না কেন, সে কখনো কখনো নিজেকে নারী আবার কখনো নিজেকে পুরুষ হিসেবে আইডেন্টিফাই করে। তার কোন নির্দিষ্ট gender বা লৈঙ্গিক পরিচয় নেই, সে Gender Neutral বা Gender Fluid।

কথাগুলো অনেকের কাছে হয়তো পরিচিত মনে হচ্ছে। সমকামিতা, উভকামিতা ইত্যাদির ব্যাপারে সামান্য ভিন্ন আঙ্গিকে প্রায় একই যুক্তি দেওয়া হয়। তাহলে Gender Dysphoria বা Gender Fludi বিষয়ক এই নতুন আবর্জনা দর্শন প্রচারের কারন কী? বা এ নিয়ে নতুন করে কথা বলার বা চিন্তিত হবার কী প্রয়োজন? একথা ঠিক যে সমকামিতা-উভকামিতা সংক্রান্ত ধ্যানধারনার সাথে Gender Fluid/Gender Dysphoria এর এ নতুন ধারনার অনেক মিল আছে। বিশেষত এ দুই ধারনার এন্ড রেসাল্ট এক। সমাজে ব্যাপকভাবে বিকৃত যৌনতার প্রসার, নারীপুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক তথা বিয়ে নামক পবিত্র ও প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি এবং ব্যক্তি পরিচয় ও সমাজ যৌনতানির্ভর হয়ে পড়া।

কিন্তু অনেক সাদৃশ্যে পাশাপাশি কিছু মূল্যবান পার্থক্যও আছে। মূল পার্থক্য হল, যখন সমকামিতা-উভকামিতা ইত্যাদির করা বলা হয় তখন স্বাভাবিকভাবে আমরা এটাকে যৌনতার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয় হিসেবে চিন্তা করি। যেকারনে সমকামিতা-উভকামিতা-পশুকামিতা-অযাচার ইত্যাদিকে স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া যৌন বিকৃতি হিসেবে চিনতে আমাদের বেগ পেতে হয় না। কিন্তু যখন একজন পুরুষের শরীরে আটকে পড়া একজন নারীর করুণ উপাখ্যান – হিসেবে হুবহু একই কথা উপস্থাপন করা হলে আমরা অনেকেই হাতসাফাইটা ধরতে না পেরে এটাকে একটি জেনুইন শারীরিক বা মানসিক সমস্যা মনে করবো। এ ধরনের মানুষের প্রতি এবং এধরনের cause এর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করা শুরু করবো। সহজ ভাষায় সমকামিতা-উভকামিতাকে সাধারন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করা যতোটা কঠিন সে একই জিনিষকে Gender Dysphoria/Gender Fluid – এর মোড়কে উপস্থাপন করা, সহানুভূতি ও গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করা ততোটাই সহজ। আর এর প্রমাণ হল ডেইলি স্টারের লাইফস্টাইলের এ আর্টিকেল। Gay Clothing বা How to dress like a Lesbian – কোন জাতীয় দৈনিকে এমন শিরোনামে অথবা এমন টপিকে কোন আর্টিকেল ছাপানো এখনো বাংলাদেশে সম্ভব না হলেও, অবলীলায় Gender Dysphoria/Gender Fluidity নিয়ে আর্টিকেল ছাপানো যাচ্ছে। এর আগেও ডেইলি স্টার সমকামি ম্যাগাযিন ‘রূপবান’ – এর প্রচারনা করেছিল, বিজ্ঞাপন ছেপেছিল। কিন্তু নিজেরা সরাসরি সমকামিতা প্রচার করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু এই নতুন “প্যারাডাইম” তৈরির নামে এখন তারা নিশ্চিন্তে সে একই কাজ করছে। এ আর্টিকেলে মূলত বিকৃতিকে উপস্থাপন করা হয়েছে শেকল ভাঙ্গা, বাক্সের বাইরে চিন্তা করা আর প্রথাবিরোধিতার সাথে। আর্টিকেলের শিরোনামের ঠিক নিচেই লেখা হয়েছে – “‘Queer’, ‘Gender Queer’; ‘Between Genders’ — words all too familiar? Sadly, they are. These derogatory terms exist in our social lexicon as many of us are still tied up in mind boxes, unable to think beyond the square, incapable of relating to non-conformity or anything that goes beyond the traditional route to life.” [Lifestyle, The Daily Star, 8th August, 2017]

এলেখাটি যখন লিখছি তখন প্রথম আলোর মাসিক ম্যাগাযিন কিশোর আলোর মাধ্যমে আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রেটোরিক প্রচার করার খবর ভাইরাল। আর এদুটি খবরের মধ্যে নিঃসন্দেহে কিশোর আলোর খবরটি অধিক গুরুত্ব পাবার দাবি রাখে। তবে আমার আশংকা হয় মোটা দাগের হবার কারনে যতো সহজে কিশোর আলোর ব্যাপারটা আমাদের চোখে পড়েছে, ডেইলি স্টারের লাইফস্টাইলের ব্যাপারগুলো হয়তো ততোটা সহজেই চোখ এড়িয়ে যায়। আর সমস্যার ধরন সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞ হবার কারনে হয়তো দীর্ঘমেয়াদে লাইফস্টাইল জাতীয় ম্যাগাযিনরা যা প্রমোট করছে, এধরনের প্রচারনা আরো বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। একারনে মিডিয়ার ব্যাপারে, মিডিয়া আমাদের চিন্তার উপর ঠিক কতোটুক প্রভাব ফেলছে, মিডিয়ার কাছ থেকে কতোটুক আমরা নিচ্ছি – এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের চিন্তাভাবনা কি মিডিয়ার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কি না সে ব্যাপারেও সতর্ক হওয়া উচিৎ।

বাংলাদেশের মিডিয়া দীর্ঘদিন ধরেই কিছু নির্দিষ্ট ধ্যানধারণা-আদর্শ সাধারন মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করছে। মিডিয়া খুব ধীরে ধীরে কিন্তু নিয়মিত কাজটা করে তাই ব্যাপারটা সবসময় হয়তো আমাদের চোখে পড়ে না। ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলা, একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা জনগোষ্ঠী ডিমনাইয করা, কোন অস্বাভাবিক আচরণ বা বিকৃতিকে স্বাভাবিক করে তোলার কাজে মিডিয়ার ব্যবহার আজকে নতুন না। বরং সোশ্যাল এঞ্জিনিয়ারিং এবং পাবলিক ওপিনিয়ন ম্যানিপুলেশানে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হল মিডিয়া। এর একটি কারন হল মিডিয়া মানুষের জন্য তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করে। যার ফলে কিছু তথ্য চেপে রাখা বা বদলে দেয়ার মাধ্যমে মিডিয়া ইচ্ছেমতো কোন বিষয়ে সাধারন মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, মিডীয়া বিভিন্নভাবে মানুষের সামনে ট্রেন্ডসেটারের ভূমিকা পালন করে। পোশাক, বই, সিনেমা, গ্যাজেট থেকে শুরু করে আদর্শ পর্যন্ত – বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মিডিয়াই মানুষকে জানিয়ে দেয় কোনটা ‘হিপ অ্যান্ড ট্রেন্ডি’ আর কোনটা সেকেল। আর যেমনটা উপরের উদাহরন থেকে দেখতে পাচ্ছেন, মিডিয়ার কাজ হল সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করা। অন্ধকারকে আলো আর আলোকে অন্ধকার হিসেবে উপস্থাপন করা।

ডেইলি স্টারের সাপ্তাহিক ম্যাগাযিন লাইফস্টাইলের আলোচ্য প্রবন্ধের লিঙ্কঃ http://ow.ly/e0JG30eiMH0


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *