নিরুপদ্রবে নিশ্চিত মৃত্যুর সুব্যবস্থা


বাড়তে থাকা আত্মহত্যার হার নিয়ে প্রতিবেদনের একটা লাইন চমকে দিল। “ঢাকায় নিরাপদে আত্মহত্যার পরিবেশ পাওয়া সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে মহাখালী থেকে বনানী রেললাইনের বিশেষ পরিচিতি আছে। ”

এখানে নিরুপদ্রবে নিশ্চিত মৃত্যুর সুব্যবস্থা আছে। তাই আত্মহননে ইচ্ছুকরা শহরের বিভিন্ন কোনা থেকে জড়ো হচ্ছে। রেললাইনের পাশে টং-দোকানে বসে ট্রেইনের অপেক্ষা করছে অচিরেই গলাকাটা লাশে পরিণত হতে যাওয়া মানুষ। এই অপেক্ষার মূহুর্তগুলোতে মানুষগুলো কী করে? রাজনৈতিক মামলায় ফিওদর দস্তেইয়েভস্কির একবার ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছিল। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবার ঠিক আগে অদ্ভূতভাবে সিদ্ধান্ত বদলানো হয়। বহু বছর পর তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দা ইডিয়ট”– এ দস্তেইয়েভস্কির এক কাল্পনিক চরিত্রের আড়ালে নিজের এই অভিজ্ঞতা পাঠকের সামনে তুলে ধরেন।

..প্রথম তিনজন বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হল। সেনারা পযিশান নিল। আমার বন্ধু ছিল বন্দীদের মধ্যে অস্টম, অর্থাৎ তার জায়গা হবার কথা থার্ড ব্যাচে। আমার বন্ধু হিসেব করে দেখলো তার হাতে আর পাঁচ মিনিটের মতো সময় আছে। এই পাঁচ মিনিটকে ওর কাছে অনন্তকালের মতো মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল সময়ের এক প্রাচুর্য হঠাৎ ওর সামনে চলে এসেছে। মাত্র ওই কয়েক মিনিট যেন ছিল শত শত যাপিত জীবনের মতো। এই সময়টাকে কিভাবে কাটানো যায় ও মনে মনে ঠিক করে নিল। সাথীদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য দুই মিনিট। নিজের জীবন, নিজের ক্যারিয়ার, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তার জন্য, আরো দুই মিনিট। শেষ মিনিটটা বরাদ্দ থাকলো চারপাশের পৃথিবীটাকে শেষবারের মতো ভালোভাবে দেখে নেওয়ার জন্য।

টং দোকানের সামনে ট্রেইনের জন্য অপেক্ষমান মানুষগুলো কি এমন হিসেব করে?

পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা মরবিড প্র্যাকটিক্যালিটি আছে। শর্ট ফিল্ম মেইকাররা এই সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করতে পারেন। মানুষ খাবে ভালো। ঠিকঠাক বানাতে পারলে বাস্তবমুখী সোশ্যাল কমেন্ট্রি হিসেবে পুরস্কারও জুটতে পারে দেশে-বিদেশে।

রেললাইনের পাশের টংঘরের বাসিন্দাদের মতে ট্রেইনের জন্য অপেক্ষামান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে মধ্যবয়েসী ছাপোষা চাকরিজীবি, আছে নানান রকমের প্যাসেঞ্জার। তাদের শেষ যাত্রার খবরগুলো টুকিটাকি হিসেবে পত্রিকার ভাঁজের মাঝে আর সাউন্ডবাইট হয়ে খবরে আসছে, কিন্তু মদমত্ত জাতি চিন্তিত না। মিডিয়া বাস্তবের বদলে বাস্তবতার একটা একটা বানোয়াট সংস্করণ আমাদের সামনে উপস্থাপন করতে আদিষ্ট। আন্তরিকভাবে সে কাজ তারা করে যাচ্ছে। ম্যাজিশিয়ানের মিসডিরেকশানের মতো মিডিয়া আমাদের বলে দিচ্ছে কোথায় তাকাতে হবে, কিন্তু হাতসাফাই চলছে অন্যদিকে। তাই স্বেচ্ছামৃত্যু এক্সপ্রেসের যাত্রীদের বদলে আমাদের মনযোগ কেড়ে নিচ্ছে খেলা, বিনোদন, রাজনীতি, গসিপ আর রুটিনমাফিক ভোগের ব্যস্ততা। চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে জিডিপি, ভোগের সুযোগ কিংবা টাচ স্ক্রিন মোবাইলে হিসেব করা ‘মধ্যম আয়ের উন্নয়নের’ গল্পে থাকা ঘাপলা। সাত বছরে দ্বিগুণ হওয়া বেকারত্বের হারের ন্যারেটিভ প্রবলেম্যাটিক। তার চেয়ে উন্নয়নের বাংলাদেশের কিসসায় বিশ্বাস করা সহজ। স্বাস্থ্যকরও।

মন্তব্য প্রতিবেদনের লিঙ্ক – https://bit.ly/2zivFp3


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *