যখন আমি ছোট ছিলাম বাসায় বিভিন্ন হোম প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে হতো। ঘর রং করা, নতুন করে মেঝে বসানো, ঘরের টুকটাক মেরামত, এসব আরকি। বাবা এসব করতে খুব ভালোবাসতেন, আর অবধারিতভাবে আমারও হাত লাগাতে হতো। কাজগুলো যে খুব একটা উপভোগ করতাম তা না, তবে এগুলো করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি।
একদম প্রথম দিকে বাবা একটা জিনিস শিখিয়েছিলেন। নতুন যেকোনো প্রজেক্ট শুরু করতে হয় পরিষ্কার, খালি জায়গা থেকে। ধরুন, বাসার কোনো একটা দেয়ালে নতুন করে রং করবেন। প্রথমে ঘষে ঘষে পুরোনো রং তুলে ফেলতে হবে। দেয়ালের ফুটো, ভাঙাচোরা, এসব ঠিক করতে হবে। তারপর নতুন রং লাগাতে পারবেন। এই কাজগুলো না করে পুরোনো রঙের ওপর নতুন করে রং চড়িয়ে দিলে অল্প ক’দিন পরই তা খসে পড়তে শুরু করবে। জায়গায় জায়গায় চলটা উঠবে। দেখবেন দেয়ালটা দেখতে আগের চেয়েও বাজে দেখাচ্ছে।
অ্যামেরিকা অনেক বাসাতে মেঝে হয় কাঠের। এগুলোকে ‘ডেক’ বলা হয়। রং করার মতো নতুন ডেক বসানোর সময়ও একই নিয়ম। প্রথম কাজ হলো পুরোনো কাঠামো ভেঙেচুরে, টুকরো টুকরো করে, প্রয়োজনে ধ্বংস করে জায়গাটা পরিষ্কার করা। সমান করে নেয়া। তারপরই কেবল নতুন করে শক্তপোক্ত, দীর্ঘস্থায়ী কিছু বানাতে পারবেন। আগের নড়বড়ে কাঠামো রেখে দিয়ে সেটার ওপর নতুন কিছু তৈরির যৌক্তিকতা নেই। এতে তেমন কোনো লাভও হবে না। পুরোনো কাঠামোর ওপর নতুন করে যা বানাবেন তা আগের মতোই নড়বড়ে হবে। যেকোনো সময় ধসে পড়া আশঙ্কা থাকবে।
পুরোনো কাঠামোর ওপর নতুন করে কিছু বানানোর আরও ঝামেলা আছে। যা-ই বানাবেন, পুরোনো কাঠামোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, মাপ ইত্যাদি মাথায় রেখে বানাতে হবে। নিজের পছন্দ আর প্রয়োজনের চেয়ে আগের কাঠামোর সীমানাগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, আপনাকে এমন কিছু একটা বানাতে হবে, যা আগের কাঠামোর সাথে খাপ খাবে। কাজেই আগের কাঠামোর সীমানার মধ্যেই আপনাকে থাকতে হবে।
আধুনিক সময়ের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় বর্তমানের আলিমদের যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও ওপরের কথাগুলো খাটে। পুরোনো, রংওঠা, জীর্ণশীর্ণ কাঠামো হলো মডার্নিসম এবং এর সাথে যুক্ত বিভিন্ন মতবাদ–লিবারেলিসম, সায়েন্টিসম, নারীবাদ, সেক্যুলারিসম ইত্যাদি।
এ মতবাদগুলোকে ভেঙেচুরে ঝেটিয়ে বিদায় করে তারপর পরিষ্কার, সমান মাটিতে নতুন কাঠামো বানাতে হবে। এগুলোর ওপর নতুন কিছু বানালে, সেই কাঠামো যতই মুনশিয়ানার সাথে তৈরি করা হোক না কেন, দিনশেষে সেটা হবে নড়বড়ে এবং পতনোন্মুখ।
কিন্তু পচন ধরা, পুরোনো কাঠামো বাদ দিয়ে নতুন করে যদি শুরু করা হয়, তাহলে দীর্ঘস্থায়ী, সত্যিকারের মাস্টারপিস বানানো সম্ভব, বিইযনিল্লাহ।
এ জন্যই পূর্ববর্তী আলিমদের কাজে এত বারাকাহ ছিল। তারা নির্মাণ করেছিলেন শক্ত মাটির ওপর। তাদের ভিত্তি ছিল সালাফুস সালেহিনের রেখে যাওয়া জ্ঞান, আর সেই জ্ঞানের উৎস ছিল কুরআন ও সুন্নাহ। যা অটল, অবিচল, নিখুঁত, পরিপূর্ণ। এ জন্যই তারা তৈরি করতে পেরেছিলেন ইসলামী জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক আর আত্মিক অর্জনের তুলনাহীন মনুমেন্ট।
আধুনিক যুগের শুরুর দিকে মুসলিমরা রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। ইউরোপীয় মডার্নিস্ট দর্শনের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে বিশ্বজুড়ে। মুসলিম-বিশ্বেও এর প্রভাব পড়ে। মুসলিম আলিমদের আলোচনা এবং কাজ এ সময় থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল হতে শুরু করে। একদিকে এসব মতবাদের জবাব দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। অন্যদিকে সামাজিক, রাজনৈতিক চাপ, কিংবা দখলদার ইউরোপিয়ান আর তাদের এজেন্টদের জবরদস্তির কারণে এসব মতবাদের আলোকে অনেকে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে শুরু করেন। এভাবে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে, একসময় এই মতবাদগুলো প্রভাবিত করতে শুরু করে ইসলামী স্কলারশিপকে। ফলে এই পচন ধরা কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে ইসলাম আর মুসলিম-বিশ্বের পুনরুত্থানের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে অনেক চিন্তাধারা।
এই পচন ধরা ক্ষয়ে যাওয়া কাঠামোকে ভেঙেচুরে, টুকরো টুকরো করতে হবে। ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে আবর্জনা। তারপর আমরা নতুন করে আত্মবিশ্বাসের সাথে তৈরি করতে পারব। বিশ্বকে দেখাতে পারব কোনো কিছু দ্বীন ইসলামের রাজকীয় সৌন্দর্য আর বিস্ময়কর দীপ্তির সমকক্ষ হতে পারে না।
ড্যানিয়েল হাক্বিকাতযু, The Modernist Menace To Islam বই থেকে নেয়া। বাংলায় ‘সংশয়বাদী’ নামে অনূদিত।