নিচের লেখাগুলো ‘ইসলামী’ ব্যাংকিং নিয়ে হলেও ‘ইসলামী’ গণতন্ত্রসহ এধরণের অন্য আরো জোড়াতালির দর্শনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য –
মনে রাখা দরকার, কৌশল বলুন আর পলিসি বলুন কোনো ক্ষেত্রেই ‘এটা বৈধ কি না’, তা আমাদের মূল প্রশ্ন না; বরং মূল প্রশ্ন হচ্ছে, ‘শরীয়াহর দাবি কী? কোন ধরনের ব্যক্তি ও সমাজ গড়ে তোলা শরীয়াহর উদ্দেশ্য?’
সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পলিসি ঠিক করা হয় উদ্দেশ্য অনুযায়ী। নিছক বৈধতার ভিত্তিতে না। কারণ, বৈধতার নীতি হলো bare minimum (ন্যূনতম) এর দর্শন। এর মাধ্যমে কখনোই কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সংস্কার সম্ভব না। বরঞ্চ এর আবশ্যিক ফলাফল হলো অন্য কোনো জীবনব্যবস্থার কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেয়া ও পিছু হটা।
প্রতিটি জীবনব্যবস্থার সামাজিক পলিসি তৈরি হয় তার নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব এবং কল্যাণ-অকল্যাণের ধারণার ভিত্তিতে। আর এই বিষয়টিই ইসলামী অর্থনীতিবিদরা বুঝতে ভুল করছেন। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এক দর্শন ও ব্যবস্থাকে তারা আজ ‘হারাম না’ এর দর্শনের ভিত্তিতে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। ফলে ক্রমেই ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলার পরিধি সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আর অন্যান্য জীবনব্যবস্থার প্রভাব ও বিস্তৃতি বাড়ছে।
ইসলামী ব্যাংকিং এর ব্যাপারে অজুহাত দেয়া হয় যে, (عموم البلوى) তথা সমস্যার ব্যাপকতার কারণে মানুষকে সুদ থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামী ব্যাংকিং আমদানি করতে হয়েছে। খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত হারাম থেকে বেঁচে থাকার জন্য রুখসতের ওপর আমল করতে হবে। মূলত এই অজুহাত নামধারী ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিচালকদের কাজকে স্থায়িত্ব দেয়ার বাহানা কেবল।
কেননা, ইসলামী অর্থনীতিবিদদের লেখা পড়লে আপনার মনে হবে না যে তারা একে পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে তৈরি করা কোনো কৌশল বা হিকমাতে আমালি বলছেন; বরং আপনি দেখবেন তারা এই ব্যাংকিং-ব্যবস্থাকে বিশুদ্ধ ইসলামী ব্যবস্থা হিসাবে উপস্থাপন করছেন। অর্থাৎ এই অর্থ-ব্যবস্থা কোনো হিকমাতে আমালী না; বরং এটাই মূল কাঠামো। যেমনটা তাকী সাহেবের লেখায় দেখা যায়। আবার অজুহাত দেয়ার সময় তারা হিকমাতে আমালীর কথা বলছেন।
এ এক বিচিত্র সাংঘর্ষিকতা।
ধরুন তর্কের খাতিরে আমরা মেনে নিলাম এটি হিকমাতে আমালী। পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে অবলম্বন করা কৌশল। প্রশ্ন হলো এই হিকমতে আমালীর চূড়ান্ত ফলাফল (end result) কী হবে? আর এই হিকমাতে আমালী অবলম্বনের কারণও স্পষ্ট করা দরকার। এর লক্ষ্য কি মূল উদ্দেশ্য অর্জন? নাকি তাকে আরও কঠিন করা?
এ কথা সত্য যে ২০১৯ সালে এ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষার ওপর আমল করা সম্ভব না। কিন্তু কৌশল অবলম্বনের উদ্দেশ্য তো এটা হওয়া উচিত ছিল যে, ২০২৯ নাগাদ কিংবা ৩৯ নাগাদ আমরা আরও ব্যাপকভাবে ইসলামী শিক্ষার ওপর আমল করার মতো যোগ্য অবস্থান বানিয়ে নেব।
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার দ্বারা কি এটা হচ্ছে? নাকি উল্টোটা হচ্ছে?
যে ‘হিকমাতে আমালী’ চিরদিনের জন্য ইসলামী শিক্ষাকে অচল করে দেয়ার ব্যবস্থা করছে, তাকে কীভাবে ইসলামী বলা যায়? কোনো কৌশলি কাজকে তখনই ইসলামী বলা যাবে যখন তা ইসলামী লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম হবে। যে কৌশলের কারণে ইসলামী জীবনব্যবস্থার রং নষ্ট হচ্ছে তার উপর ইসলামী সিল লাগিয়ে দ্বীনের নামে পুঁজিবাদের বৈধতা কেন দেয়া হচ্ছে?
এর দ্বারা বরং ইসলামী বিপ্লব ও পুনর্জাগরণ বিপন্ন হচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংক: ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর বই থেকে।