পৃথিবীর প্রায় সব ধরণের বিচার ব্যবস্থায় একটা মূলনীতি গ্রহণ করা হয় – Presumption Of Innocence। যার অর্থ অভিযোগ প্রমাণ হবার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ গণ্য হবে। খুবই সোজাসাপ্টা কনসেপ্ট। কারো বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আসলে তাকে অটোম্যাটিক খুনী মনে করা হবে না। তাকে খুনের শাস্তি দেয়া হবে না। এমনকি তাকে ক্রিমিনালও গণ্য করা হবে না। আগে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হতে হবে। একইভাবে কারো বিরুদ্ধে ধর্ষনের অভিযোগ উঠলেই তাকে ধর্ষক মনে করা হবে না। আগে অভিযোগ অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে।
ইসলামী শরীয়াহতে এই ধারণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস অনুযায়ী প্রমাণ উপস্থাপনের দায়িত্ব অভিযোগকারীর বা দাবিকারীর।
একইভাবে বিচারের সময় বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনা আবশ্যক। কারো ওপর শাস্তি প্রয়োগ করার শর্ত হল অভিযোগ বা অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া, ইত্যাদি।
সেক্যুলার আইনেও এই ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। ইন ফ্যাক্ট, জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ করা হলে, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হবার আগ পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়া একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার। বিচারিক প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়াও তার অধিকার।
এই মূলনীতির ওপর এতো গুরুত্ব দেয়ার কারণটা বোঝা সহজ। এই মূলনীতি অনুসরণ না করলে অসংখ্য নির্দোষ মানুষ সাজা পাবে। ২০১৫ সালে যেমন মুম্বাইয়ের একজন মহিলা এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে। মহিলা অভিযোগটা তোলেন ফেইসবুকে। তার ফেইসবুক পোস্টে সেই ব্যক্তির একটা ছবিও যুক্ত করে দেন। তারপর সেই পোস্ট ভাইরাল হয়। নেটিযেনরা সেই ব্যক্তিতে ‘পার্ভার্ট’ বলে আখ্যায়িত করে। ইন্ডিয়ান মিডিয়া তার নাম দেয় ‘প্রেডেটর অফ দিল্লী’।
৪ বছর পর দিল্লী কোর্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দোষ ঘোষণা করে। কিন্তু ততোদিনে মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে সেই ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছে। তারপর আর কোথাও চাকরি মেলেনি। আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও ততোদিনে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে, সে নিঃস্ব। এই কারণে ‘Presumption of Innocence’-এর মূলনীতি অনুসরণ করা জরুরী। এবং ট্রায়াল বাই মিডিয়া এজন্যই অত্যন্ত বিপদজনক।
কিন্তু আমাদের দেশে হরহামেশা মিডিয়া ট্রায়াল হয়। প্রিসাম্পশান অফ ইনোসেন্সের কোন বালাই নেই। কারো বিরুদ্ধে যদি ঠিক জায়গা থেকে অভিযোগ আসে, তাহলে কোন ধরণের তথ্য, প্রমাণ কিংবা বিচারের আগেই মিডিয়া তাকে দোষী প্রমাণ করে ফেলে। অভিযোগ যতোই হাস্যকর কিংবা অবিশ্বাস্য হোক না কেন, কিচ্ছু যায় আসে না। অনেক সময় দেখা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতের রায়ে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়েছে, কিন্তু তবু তার গায়ে সেই অভিযোগের তকমা লেগে আছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টা হল আমরা নিজেরাও মিডিয়ার সুরে নাচি। মিডিয়া যাকে দোষী তাকে দোষী মনে করি। শুধুমাত্র অভিযোগ যখন আমার চেনা কারো ওপর আসে, তখন একটু নড়েচড়ে বসেই। সিস্টেমের নাইনসাফী নিয়ে আবেগতাড়িত কথা বলি। কিন্তু পরের দিনই অন্য কারো মিডিয়া ট্রায়ালের সক্রিয় অংশীদার বনে বসি। ঐ যে ‘গেল মেন অ্যামনিশিয়া ইফেক্ট’। [১]
আমাদের মস্তিস্কের প্লেসার সেন্টারের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার ফিডব্যাক লুপের প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। অনলাইনের ‘হট টপিক’ নিয়ে পোস্ট দেয়া, মন্তব্য করা, একটা সিদ্ধান্ত টানার তাড়নাকে নিয়ন্ত্রন করা বেশ কঠিন। মতপার্থক্য আছে এমন মানুষের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘনের প্রবণতায় বাঁধ দেয়া আরো কঠিন। শুকনো কথা দিয়ে এই রঙিন আকর্ষনের লাগাম টানতে কনভিন্স করা বেশ কঠিন। তবু কথাগুলো বলা দরকার। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য কিংবা অভিযোগের ভিত্তিতে, কিংবা মিডিয়ার প্রচারণার বেইসিসে কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় না। কাউকে ঢালাওভাবে ধর্ষক, খুনী, জঙ্গি, যিনাকারী কিংবা অন্য কিছু বলে প্রচার করা হলেই তাকে অপরাধী গণ্য করা যায় না। নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে সেই অভিযোগ প্রমাণিত হতে হয়। এটা ইনসাফ করার একটা মৌলিক আবশ্যিকতা।
একই সাথে এটাও মনে রাখা দরকার যে, সবার কাছে অপরাধের সংজ্ঞা এক না। তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছিল। কিন্তু তিতুমীরের দ্বীন অনুযায়ী তিনি নির্দোষ ছিলেন। তিনি অপরাধ করেননি বরং প্রশংসনীয় ইবাদত করেছিলেন, রাহিমাহুল্লাহ। অন্যদিকে ব্রিটিশ রাজের দ্বীন অনুযায়ী তিতুমীর বিপজ্জনক এবং জঘন্য অপরাধী ছিলেন। কে দোষী, কে নির্দোষ সেটা সবসময় কোন না কোন দ্বীনের সাপেক্ষে হিসেব করা হয়। আমরা দ্বীন ইসলামের সাপেক্ষে সেটা করছি না, তাও খেয়াল রাখার দরকার।
১। ‘গেল মেন অ্যামনিশিয়া ইফেক্ট’ (Gell Mann Amnesia Effect): https://web.facebook.com/AsifAdnan88/posts/2875045772799902