২০০৩ সালে অ্যামেরিকান গ্লোবাল পলিসি থিংকট্যাঙ্ক RAND Corporation একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ রিপোর্টের বিষয় হল – কীভাবে এবং কাদের সহায়তায় অ্যামেরিকার বৈশ্বিক পলিসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক নতুন “ইসলাম” বানানো যায়। Civil Democratic Islam: Partners, Resources & Strategies নামের এই রিপোর্টে অ্যামেরিকাবান্ধব নতুন এই ‘ইসলামের’ নাম দেয়া হয় ‘মডারেট ইসলাম’ বা Civil Democratic Islam। ২০০৭ সালে “Building Moderate Muslim Networks নামে র্যান্ড একটি বিস্তারিত ফলোআপ রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় Promoting Online Voices for Countering Violent Extremism শিরোনামে তৃতীয় একটি প্রতিবেদন। আজ আমরা ‘মডারেট ইসলাম’ নিয়ে র্যান্ডের প্রথম প্রতিবেদনের দিকে তাকাবো। এই প্রতিবেদনে মোটাদাগে নিচের বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে।
ক) কেন অ্যামেরিকাবান্ধব এই নতুন ‘ইসলাম’-এর প্রবর্তন ও প্রচার করা উচিৎ
খ) মুসলিমদের শ্রেণীবিভাগ
গ) অ্যামেরিকা কী ধরণের ইসলাম ও মুসলিম তৈরি করতে চায়। একজন মডারেট মুসলিমের বৈশিষ্ট্য কী কী হবে?
ঘ) কীভাবে মুসলিমদের মধ্যে এই ‘মডারেট ইসলাম’ –এর প্রচার ও প্রচলন করা হবে।
অ্যামেরিকা বান্ধব মডারেট ইসলাম তৈরির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে র্যান্ডের বক্তখুব স্পষ্ট। অ্যামেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব এমন এক ‘ইসলাম’ চায় যা ‘গণতন্ত্র এবং আধুনিকতাকে গ্রহণ করে নেবে’। তারা এমন এক মুসলিম বিশ্ব চায় যা ‘গণতান্ত্রিক, সামাজিকভাবে প্রগতিশীল, স্থিতিশীল, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ম মেনে চলে’। সেই সাথে অ্যামেরিকা সরাসরি ইসলামের সাথে ‘সভ্যতার সংঘাতে’ জড়াতে চায় না।
এটা পশ্চিমা ডাবলস্পিক। এমন কথা যা শব্দের মারপ্যাঁচে মূল বাস্তবতা আড়াল করে। তাই র্যান্ডের মূল কথাটা সহজ বাংলায় বলি। ওরা এমন ‘ইসলাম’ চায় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠা বিশ্বব্যবস্থাকে মেনে নেবে। যে ‘ইসলাম’ ইস্রাইল রাষ্ট্র, উপসাগরীয় যুদ্ধের গণহত্যা, মুসলিম বিশ্বের স্বৈরাচারী তাগুত শাসকের পেছনে পশ্চিমা সমর্থন, মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে চালানো পশ্চিমা নব্য-ঔপনিবেশিক লুটপাট মেনে নেবে বিনা বাক্য ব্যয়ে। যা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ও চিন্তার আগ্রাসনের সামনে নতি স্বীকার করে লিবারেল-সেক্যুলারিসমের সাথে খাপ খাইয়ে ইসলামকে নতুন করে ব্যাখ্যা করবে। এমন এক ‘ইসলাম’ যা পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে কোন সংঘাত জরুরী মনে করে না। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট – এমন ‘ইসলাম’ যা ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী শাসনের কথা বলে না। সহজ ভাষায় এই হল ‘মডারেট ইসলাম’ তৈরির কারণ।
কিন্তু ‘মডারেট ইসলাম’ তৈরির কাজটা কীভাবে হবে? কে করবে? কাজটা সহজ না। র্যান্ড বেইসিকালি মৌলিকভাবে ইসলাম ধর্মকে বদলে দেয়ার কথা বলছে। প্রতিবেদনের লেখিকার ভাষায় – ‘রাষ্ট্রগঠন যদি দুরূহ হয়ে থাকে তাহলে ধর্ম-গঠন আরো অনেক বেশি বিপদজনক এবং জটিল’।
‘বিপদজনক এবং জটিল’, কিন্তু র্যান্ডের মতে অসম্ভব না। তবে কাজটা করতে হলে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন আদর্শিক ও ধর্মীয় ধারাগুলোর মধ্য থেকে কিছু কিছু ধারাকে বেছে নিয়ে তাদের সাথে কাজ করতে হবে। তাদেরকে সমর্থন দিতে হবে। এই সমর্থন আর্থিক হতে পারে, কূটনৈতিক হতে পারে, কিংবা হতে পারে মিডিয়ার দিক থেকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু ধারার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হতে যাতে তারা পশ্চিমে দেখানো ছকের মধ্যে চলে আসে। পশ্চিমের ঠিক করে দেয়া বাক্সের বাইরে না যায়। কোন কোন ধারাকে বাছাই করা হবে, কাদের সাথে মিলে কাজ করা হবে, তা ঠিক করতে হবে খুব সতর্কতার সাথে। র্যান্ডের প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য এই জটিল কাজটার ব্যাপারে অ্যামেরিকান সরকারকে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া।
সহজ ভাষায় বললে – আদি ও অকৃত্রিম ইসলাম অ্যামেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যবাদের জন্য সমস্যা মুসলিমদের মধ্যে না, সমস্যা ইসলামেই। এটা অ্যামেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। তাই ইসলামকে বদলে দিতে হবে। এমন এক ‘ইসলাম’ তৈরি ও প্রচার করতে হবে যা নিরীহ। যা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসন আর লুটপাটের জন্য হুমকি না। যা লিবারেল-সেক্যলারিসমের জঘন্য কুফরকে মেনে নিতে রাজি। তবে এই কাজটা অ্যামেরিকা বা ইউরোপ সরাসরি করতে পারবে না। এটা করাতে হবে মুসলিমদের সামনে রেখে। এমন কিছু ‘মুসলিম’-কে বাছাই করতে হবে যারা ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে পশ্চিমা এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করবে। কোলাবোরেটর – দালাল – পশ্চিমা ‘রাজাকার’। আর যারা দালালী করবে না, তাদেরকে নানানভাবে চাপ দিয়ে করে কিংবা সুবিধা দিয়ে তুলনামূলক ‘পশ্চিমবান্ধব’ একটা ইসলাম প্রচার করাতে হবে।
র্যান্ডের ভাষ্যমতে ‘মডারেট ইসলাম’ এর বিপরীত হল র্যাডিকাল ফান্ডামেন্টালিসম (উগ্র মৌলবাদী ইসলাম)। উগ্র মৌলবাদী ইসলাম বলতে র্যান্ড আসলে কী বোঝায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা জরুরী। কারণ র্যান্ডের পুরো আলোচনার কাঠামো গড়ে উঠেছে উগ্র মৌলবাদের এই সংজ্ঞার ওপর। এই সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে র্যান্ড ‘মডারেট’ বা ‘মধ্যপন্থীর’ সংজ্ঞা দাড় করিয়েছে। উগ্রবাদী হিসেবে প্রতিবেদনের বিভিন্ন জায়গায় যেসব মুভমেন্টের নাম এসেছে তাদের মধ্যে আছে – হিযবে ইসলামী (আফগানিস্তান/গুলাবুদ্দিন হেকমতিয়ার), তালিবান, আল-[কা]য়েদা, হামাস, ইসলামিক স্যালভেইশান ফ্রন্ট, হিয[বু]ত তা[হ]রীর, ইরানীয়ান রেভ্যুলুশানারী গার্ডস, ইত্যাদি। এ থেকে মনে হতে পারে যে উগ্র মৌলবাদ বলতে তারা হয়তো বিভিন্ন ইসলামী মুভমেন্টকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু তারা আসলে কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি (যেমন সশস্ত্র পদ্ধতি) বা কর্মকান্ডকে উগ্রবাদ বলছে না। তাদের দেয়া উগ্রবাদের সংজ্ঞা আর ব্যাপক। আরো বিস্তৃত।
র্যান্ডের এই পুরো প্রতিবেদন পড়লে পরিষ্কার হয়ে যায় যে তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, উগ্রবাদ হল এমন সবকিছু যা আধুনিক গণতন্ত্র, লিবারেল সেক্যুলার মূল্যবোধ, এবং অ্যামেরিকার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। যারা উম্মাহর কথা বলে, এথনিসিটি (বর্ণ পরিচয়) কিংবা পশ্চিমের ঠিক করে দেয়া জাতিরাষ্ট্রের সীমানার ভিত্তিতে চিন্তা করে না। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যার মধ্যে থাকবে সে উগ্র মৌলবাদী মুসলিম। সে সশস্ত্র নাকি নিরস্ত্র, তা গুরুত্বপূর্ণ না (যেমন হি[য]বুত তা[হ]রীর সশস্ত্র দল না)। সে নির্বাচনে কখনো অংশগ্রহণ করেছে কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ না (যেমন আলজেরিয়ার FIS নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল)। সে যদি সশস্ত্র হয় তাহলে তার অস্ত্র হাতে নেয় জাস্টিফাইড কি না, আত্মরক্ষার জন্য নেয়া কি না, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নেয়া কি না, আগ্রাসী শত্রুর মোকাবেলায় নেয়া কি না – তাও গুরুত্বপূর্ণ না। এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকাই যথেষ্টা। আর র্যান্ডের মতে, ইসলামী উগ্র মৌলবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের অবস্থান থেকে চিন্তা করা। ইসলামী শাসন চাওয়া এবং এর জন্য কোন না কোন ভাবে কাজ করে। সেটা হাত দিয়ে হোক, মুখ দিয়ে হোক বা কলম দিয়ে হোক।
কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা সহজে বোঝা যাবে।
প্রতিবেদনে আলজেরিয়ার ইসলামিক স্যালভেইশান ফ্রন্ট (FIS) এর মুখপাত্রক আলি বেনহাজকে উগ্র ইসলামী মৌলবাদী আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে, ‘ইসলামী মৌলবাদ গণতন্ত্র এবং আধুনিক (মানে পশ্চিমা) সমাজের কেন্দ্রীয় মূল্যবোধগুলোর প্রতি মৌলিক এবং পূর্ণাংগ প্রত্যাখ্যানের প্রতিনিধিত্ব করে’। তাই বেনহাজ একজন মৌলবাদী, কারণ তিনি বলেছিলেন ‘…গণতন্ত্রের ঘাড় ভেঙ্গে দিতে হবে’। যদিও বেনহাজ এবং তার দল, ইসলামিক স্যালভেইশান ফ্রন্ট ১৯৯০ এ আলজেরিয়ার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। শুধু তাই না ৯০ এর ৯১ এর নির্বাচনে স্যালভেইশান ফ্রন্ট জিতেছিল। কিন্তু আলজেরিয়ার সামরিক জান্তা – সেক্যুলার এবং অ্যামেরিকার মিত্র – সেই নির্বাচনের ফলাফল মানেনি। হত্যা দমন, পীড়ন, নির্যাতনের মাধ্যমে আলজেরিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু র্যান্ডের জন্য গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলা উগ্রবাদী হিসেবে গণ্য হবার জন্য যথেষ্ট।
একইভাবে উগ্র মৌলবাদের উদাহরণ হিসেবে শায়খ আব্দুর রাহিম গ্রীন এর নিচের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে –
‘ইসলাম প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষে পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা অন্য কারো বিরোধিতা করে না।
আত্মাভিমানে আঘাত লাগার কারণে কিংবা সম্পদ বা জমি দখলের জন্য ইসলাম যুদ্ধ করে না। যুদ্ধের উদ্দেশ্য একটাই – দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
জি[হা]দের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথম পর্যায় হল সঠিক বিশ্বাস ও আকিদাহ অর্জন করা, নিজের ভেতরের সব সন্দেহ ও সংশয় দূর করা…দ্বিতীয় পর্যায়, শত্রুর হাত থেকে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোকে মুক্ত করা। আর সর্বশেষ পর্যায় হল, কাফিরদের ভূমিতে আল্লাহ্র বিধান প্রতিষ্টার পথ উন্মোচনের জন্য যুদ্ধ করা’।
বলাবাহুল্য এই বক্তব্য মোটাদাগে ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম অবস্থান। ইসলামের শুরু থেকে প্রথম তেরশো বছর এটি ছিল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত অবস্থান। কিন্তু র্যান্ডের অবস্থানটা এখানে খেয়াল করুন। যারা ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত অবস্থানের কথা বলছে, র্যান্ডের মতে তারা উগ্র মৌলবাদী। এই অবস্থান ইসলামি শরীয়াহ, কুরআন-সুন্নাহ এবং সালাফুস সালিহিনের অবস্থানের আলোকে সঠিক কি না, সেটা এখান বিবেচ্য বিষয় না। উগ্রতা আর সহনশীলতার মাপকাঠি হল পশ্চিমা এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্যতা, আর কিচ্ছু না।
তৃতীয় উদাহরণ। ইসলাম অনলাইন সাইটে প্রকাশিত একটি লেখাকে উগ্রবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইসলামঅনলাইন এর এই লেখায় বলা হয়েছে –
‘কুরআন এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কথা প্রচার করা (অর্থাৎ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দোহাই দিয়ে কুরআনের আয়াত ও বিধান পুনঃব্যাখ্যা করার কথা বলা) লোকেদের অধিকাংশই পুরোপুরিভাবে পশ্চিমের দার্শনিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণাগুলো আত্মস্থ করেছে। আজকের যুগে সরাসরি সংঘাত আর সামরিক অভিযান হল সংস্কৃতি ও বাজার নিয়ন্ত্রনের সেকেন্ডারি (গৌন) উপাদান। পরিবর্তনের মূল হাতিয়ার হল মানুষের অভ্যাস এবং লাইফস্টাইল। (এগুলো পরিবর্তনের) মাধ্যমে মুক্ত চিন্তার স্বাধীন ভোক্তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা মুক্ত বাজার নিশ্চিত করা যায়।’ [লেখক, আহমেদ কামাল সুলতান]
পশ্চিমা চিন্তার আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন এবং নব্য সাম্রাজ্যবাদের এমন তাত্ত্বিক সমালোচনাও র্যান্ডের চোখে প্রবলেম্যাটিক এবং উগ্রবাদের দুর্গন্ধযুক্ত। লেখক এখানে আধুনিক সময়, আপেক্ষিকতা আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দোহাই দিয়ে ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা করার প্রবণতার বিরুদ্ধে বলেছেন, তাই র্যান্ডের মতে তার এই অবস্থান উগ্র। উল্লেখ্য, ইসলামঅনলাইন ইউসুফ আল-ক্বারদ্বাউয়ির অধীনে পরিচালিত সাইট। এবং র্যান্ডের মতে ক্বারদ্বাউয়ি মৌলবাদী না, বরং রিফর্মিস্ট বা সংস্কারপন্থী ট্র্যাডিশানালিস্ট। কিন্তু তবু ওপরের এই কথাগুলো র্যান্ডের কাছে উগ্র মৌলবাদী বক্তব্য।
উগ্রবাদী চিন্তার আরেকটি উদাহরণ হিসেবে এই প্রতিবেদনে ইসলামিক সেন্টার অফ ওয়াশিংটনের সাবেক ইমাম মুহাম্মাদ আল-আসির লেখা একটি গবেষণাপত্রের কথা বলা হয়েছে। আল-আসি এখানে বলেছেন –
‘রাজনীতির পশ্চিমা সংজ্ঞা কলঙ্কিত এবং কলুষিত। আর রাজনীতির ইসলামী সংজ্ঞা পরিষ্কার এবং সুস্থ। (মুসলিমদের উচিৎ) কুফরি ব্যবস্থার পতন ঘটানো, এবং কথিত ‘আধুনিক ও উন্নত বিশ্ব’এর অংশ হওয়া থেকে বিরত থাকা। (কারণ ‘আধুনিক’ আর ‘উন্নত’ বিশ্বে) পুঁজিবাদ আর মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো গালভরা নাম দিয়ে অর্থনৈতিক শোষনকে জায়েজ করা হয়।’
এর কাছাকাছি বক্তব্য অনেক কমিউনিস্টের আছে। এর চেয়ে আরো অনেক বেশি ‘গরম’ কথাবার্তা অনেক মার্ক্সিস্ট অ্যাকাডেমিক অনেক সময় বলেছে। আজো বলে। তাদের কথা উগ্রবাদ না। কিন্তু মুহাম্মাদ আল-আসির কথা উগ্রবাদী। এই বক্তব্য কেন উগ্রবাদী? কারণ এর মাধ্যমে পশ্চিমা রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। আর র্যান্ডের মতে এগুলো উগ্র মৌলবাদী ইসলামের সুস্পষ্ট নিদর্শন।
এরকম আরো উদাহরণ দেয়া সম্ভব। কিন্তু আশা করি মূল পয়েন্টটা পাঠক বুঝতে পেরেছেন। উগ্র মৌলবাদ বলতে র্যান্ড আসলে আদি ও অকৃত্রিম ইসলামকে বোঝাচ্ছে। যারা মনে করে ইসলাম শুধু কিছু বিশ্বাস, ইবাদত আর আচার-অনুষ্ঠানের নাম না, বরং ইসলাম হল একটি পলিটিকো-সোশিও-একোনমিক সিস্টেম। একটি সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, একটি শাসন ব্যবস্থা’ – তারাই মৌলবাদী। যারা মনে করে যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, আল্লাহ্র যমিনে আল্লাহ্র আইন বাস্তবায়ন করতে হবে, তারা মৌলবাদী। যারা এনলাইটেনমেন্টের মূল্যবোধগুলোকে সর্বজনীন মনে করে না, যারা লিবারেলিসম এবং সেক্যুলার হিউম্যানিসমকে ইসলামের সাংঘর্ষিক মনে করে এবং এই দর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে তারা মৌলবাদী। যারা অ্যামেরিকা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী ব্যবস্থা আনতে চায় তারা উগ্রবাদী। যারা লিবারেল ক্রুসেইডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাঁরা উগ্রবাদী। আর যারা এর উল্টোটা তারা হল মডারেট। অ্যামেরিকা আর পশ্চিমের গৃহপালিত ‘মুসলিম’। ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নের এজেন্ট, দালাল, পশ্চিমা রাজাকার কিংবা ভীত, স্বন্ত্রস্ত, কাপুরুষ সহযোগী। এই হল বিভিন্ন গালভরা কথাবার্তার আড়ালে র্যান্ডের মূল বক্তব্য।
গত পর্বে আমরা ‘লর্ড ক্রোমার’রের কথা বলেছিলাম। ক্রোমারের মতে ‘ইসলামিসম’ (ইসলামপন্থা) হল – ইসলামী শরীয়াহ এবং শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতা গড়ার আকাঙ্ক্ষা। ক্রোমারের ভাষায় – কেবল মোহাম্মাদান নীতিমালা আর প্রাচ্যীয় ধ্যানধারণার ভিত্তিতে গড়া সরকারকে ইউরোপ মেনে নিবে, এমন ধারণা করাই হাস্যকর। অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এর সাথে জড়িয়ে আছে, (তাই এমন কিছু মেনে নেয়া সম্ভব না)’। ক্রোমার ‘ইসলামিসম’ এর যে সংজ্ঞা দিয়েছিল তার সাথে র্যান্ডের দেয়া উগ্র মৌলবাদী ইসলাম এর তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। মূল এজেন্ডা সেই একই। শত বছরের পার্থক্যে খুঁটিনাটি কিছু বিষয় বদলেছে কেবল।
Civil Democratic Islam – http://ow.ly/f88Q30foshL