হাতসাফাই – ‘পারস্পরিকতা’


কিছুদিন আগে একটা খবর ভাইরাল হয়েছিল। পশ্চিমের চকচকে জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের বঞ্চিতমানুষকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে এক ডাক্তার দম্পতি। কাহিনী শুনে সবাই যখন মোটামুটি আবেগে গদগদ, তখন জানা গেল এই দম্পতি মানবতার সেবা করতে ঠিক না, বরং খ্রিস্টান মিশনারী হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্য চিকিৎসার আড়ালে মুসলিমদের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করা। মহান চিকিৎসক দম্পতির মিশনারী পরিচয় প্রকাশিত হবার পর শুরু হল প্রতিবাদের ঝড়। অবশ্যই মুসলিমদের দিক থেকে। এ সময় অনেক সেক্যুলাররা হাজির হয় একটা আরগুমেন্ট নিয়ে।

যদি মুসলিমরা খ্রিস্টানদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে পারে এবং এটাকে সওয়াবের কাজ মনে করে, তাহলে খ্রিস্টানরা কেন মুসলিমদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতে পারবে না?

এর বিভিন্ন ভ্যারিয়েশান বের করা সম্ভব। যেমন –

‘যদি মুসলিমরা পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম প্রচারের অধিকার চায় তাহলে মুসলিম দেশগুলোতে খ্রিস্টানদের খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অধিকার দেয়া উচিৎ’।

‘যদি মুসলিমরা হিন্দুদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াহ করতে চায়, তাহলে ইসকনকে মুসলিমদের মধ্যে হিন্দু ধর্মের দাওয়াহ করতে দেয়া উচিৎ’, ইত্যাদি।

নিরেট সেক্যুলারদের পাশাপাশি ইসলামিস্টের পোশাক পরা অনেক সেক্যুলারও (বিশেষ করে পোস্ট-জামাতিরা*) এ যুক্তি দিয়ে থাকেন। এরকম একটা যুক্তি হল –

‘কোন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করলে আমরা আনন্দিত হই। অন্যদিকে কোন মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করলে আমরা তার মৃত্যুদন্ডের কথা বলি। এটা তো স্ববিরোধি। আমাদের এই স্ববিরোধিতা ত্যাগ করা উচিৎ।

আরগুমেন্টা বহুল প্রচলিত এবং পুরনো। এটা লিবারেল-সেক্যুলার ডিসকোর্সের খুব পছন্দের একটা আরগুমেন্ট। এটা ‘সহিষ্ণুতা’, ‘সম্প্রীতি’ এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সেক্যুলার চরিত্রের অন্যতম ভিত্তি। আজ ইসলাম নিয়ে বলা হলেও কয়েক শতাব্দী আগে খ্রিস্টধর্ম নিয়েও ঠিক একই যুক্তি দেয়া হচ্ছিল। যেমন – ‘খ্রিস্টানরা জাপানে কিংবা আফ্রিকায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করছে। তাহলে ইউরোপে অন্য ধর্ম প্রচারে কেন বাঁধা দিচ্ছে? এমনটা হওয়া উচিৎ না। প্রত্যেক ধর্মের লোকেরা অন্য সব ধর্মের লোকদের এ অধিকার স্বীকার করে নেবে। এটা একধরনের পারস্পরিকতার (reciprocity) সম্পর্ক’।

এ যুক্তিকে প্রথম জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন সতেরশো শতাব্দীর ফ্রেঞ্চ দার্শনিক পিয়ের বেল। বেলের আরগুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক সময়ে য়্যুরগ্যুন হেইবারম্যাস, জন রলসসহ অনেকে দাবি করেছেন, যদি এই পারস্পরিকতার মেনে নেয়া হয় তাহলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার একটা সর্বজনীন ভিত্তি পাওয়া যাবে। সংক্ষেপে, আজকের সেক্যুলার এবং ইসলামিস্ট সেজে থাকা সেক্যূলারদের মুখস্থ করা আরগুমেন্টের উৎস।

সেক্যুলার প্যারাডাইমে বেড়ে ওঠার কারণে আমাদের কাছে এ আরগুমেন্ট যৌক্তিক মনে হয়। স্বতঃসিদ্ধ মনে হয়। কারণ এই প্যারাডাইম চেতন এবং অবচেতনভাবে আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু যদি দূরে সরে এসে দেখা হয়, তাহলে আরগুমেন্টটা আসলে এয়ারটাইট মনে হয় না। ইন ফ্যাক্ট, একটু খুটিয়ে দেখলে আমরা আবিষ্কার করবো, যৌক্তিক হবার ভান করলেও এটা আসলে কোন যুক্তিই না। বরং এক ধরনের ইনফরমাল ফ্যালাসি। সেক্যূলারিযমের এই উপসংহারের পেছনে একটা অ্যাসাম্পশান বা ধারণা আছে। সেই ধারনাটা হল – “সব ধর্ম সমান। সব ধর্ম একই শ্রেণীতে পড়ে। তাই সবাইকে সমানভাবে দেখা হবে”।

যদি আমরা মেনে নিতাম যে ইসলাম, খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম, প্রকৃতিপূজা ইত্যাদি সমান – অথবা যথেষ্ট পরিমানে সাদৃশ্যপূর্ণ তাহলে সেক্যূলারিযমের এ যুক্তি খাটে। তাহলে মুসলিম দা’ঈ, খ্রিস্টান মিশনারী আর ইসকনের হয়তো তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য থাকে না। কিন্তু এ জায়গাটাতেই আপত্তি। আমরা মনে করি না যে এই ধর্মগুলো সমান, এবং এগুলো একই শ্রেণী বা ক্যাটাগরিতে পরে। এগুলো সমান না, কারণ সত্য আর মিথ্যা সমান না। এগুলোর মধ্যে একটা হল চিরন্তন মুক্তির পথ আর বাকিগুলো দেবে চিরন্তন শাস্তির রাস্তা। এ দুটো ফলাফলকে ঠিক সমান বলা যায় না, তাই না?

কোন ছাত্র যদি, পারস্পরিকতা আর সহিষ্ণুতার দোহাই দিয়ে বলে, পরীক্ষায় সঠিক উত্তরের জন্যে যেহেতু নাম্বার দেয়া হয় তাই ভুল উত্তর দিলেও নাম্বার দেয়া উচিৎ, তাহল কি সেটা যৌক্তিক?

আমি দশজনের কাছে জানতে চাইলাম মুহাম্মাদপুর যাবার বাস কোনটা। নয়জন ভুল উত্তর দিলো। একজন ঠিক উত্তর দিলো। আমি কি সবগুলো উত্তরকে সমান ধরে নেবো? এগুলো সব একই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দেয়া উত্তর – এই অর্থে তারা সমান। কিন্তু সঠিক হবার দিক দিয়ে কি সবগুলো উত্তর সমান? অবশ্যই না। একটা সত্য, বাকিগুলো ভুল। একটা আপনাকে গন্তব্য নিয়ে যাবে। বাকিগুলোর অনুসরণ করলে আপনি পথ হারাবেন। ধর্মগুলো এই অর্থে সিমিলার যে, প্রত্যেক ধর্মের অনুসারী তার ধর্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু এতোটূকুন সাদৃশ্য দিয়ে সহিষ্ণুতার প্রশ্নের সমাধান হয় না।

সেক্যুলাররা বিশ্বাস করে কোনটা সত্য, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হল প্রত্যেক ধর্মের অনুসারী নিজ ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। এখানে কমন ফ্যাক্টর হল বিশ্বাস। তারা ধরে নেয় যে সব ধর্মই ভুল (নাস্তিকতা)। অথবা, কোন ধর্ম সঠিক আর কোন ধর্ম ভুল সেটা নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় আমাদের নেই (অজ্ঞেয়বাদ)। তাই সব ধর্ম সমান।

ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, কোন ছাত্র এসে বললো-

মানুষ মাত্রই ভুল করে। শিক্ষকরাও মানুষ, তারাও ভুল করেন। তাই পরীক্ষার খাতা দেখার সময় উত্তর সঠিক নাকি ভুল, সেটা বিবেচ্য না। কারণ সঠিক কোনটা সেটা নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় আমাদের নেই। নাম্বারিং করার সময় বিবেচ্য বিষয় হল যে লিখেছে, সে ঐ উত্তরকে সত্য মনে করে কি না। যেহেতু সে নিজের উত্তর ঠিক ভেবেছে ওটাই যথেষ্ট।

এ দাবি কি যৌক্তিক?

অথবা সেক্যূলারদের হৃদয়ের কাছের একটা উদাহরণ দেয়া যায়।
একদল মানুষ যেহেতু বিবর্তনবাদকে সত্য মনে করে, এবং আরেকদল যেহেতু বিবলিকাল ক্রিয়েশনিযমকে সত্য মনে করে। তাই স্কুলে দুটোই পড়াতে দেয়া উচিৎ। যে পরীক্ষায় বিবর্তনবাদের কথা লিখবে সেও ঠিক, যে বিবলিকাল ক্রিয়েশনিময বা ইন্টেলিজেন্ট ডিযাইনের কথা লিখবে সেও ঠিক। কারণ কোনটা সত্য সেটা নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় আমাদের নেই। বিবেচ্য বিষয় হল ছাত্র তার উত্তরটা বিশ্বাস করে কি না। সেক্যুলাররা কি এটা মেনে নেবে?

কোনটা বিবেচ্য বিষয়, কোন জিনিসটা গুরুত্ব পাবে – সত্য নাকি বিশ্বাস – এই হল মতপার্থক্যের জায়গা। এই মতপার্থক্য নিয়ে কথা না বলে সহিষ্ণুতা আর সম্প্রীতির ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে লাভ নেই। কারণ অনেক পরিশীলতা, সূক্ষতা আর বুদ্ধিবৃত্তিকতার দাবি করলেও সেক্যুলারিযম আসলে যা নিয়ে আসছে সেটা কোন আরগুমেন্টই না। বরং এক ধরনের সার্কুলার রিযনিং। যেটা তাদের উপসংহার সেটাকে প্রথমেই তারা প্রমাণিত সত্য বলে ধরে নিয়েছে –

যেহেতু সব ধর্ম সমান,
তাই সব মানুষের উচিৎ সকল ধর্মকে সমান গণ্য করা,
ধর্মের অনুসারীরা মানুষ। তাই ধর্মের অনুসারীদের উচিৎ বাকি সব ধর্মগুলোকে সমান মনে করা।

অদ্ভুত ব্যাপার হল বুঝে-না বুঝে ধরনের নিম্নমানের একটা হাতসাফাইয়ের পর ঔদ্ধ্যতের সাথে তাদের অপ্রমাণিত বিশ্বাসকে সত্য বলে মেনে না নেয়া সবাই বর্বর, হিংস্র, বোকা, মূর্খ ইত্যাদি প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং দুঃখের বিষয়টা হল মুখস্থ অনুকরণ করে জাতে উঠতে চাওয়া পরাজিত মানসিকতার অনেক মুসলিম এই ধরনের কথাবার্তা বলাকে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ ভেবে বসে আছেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *