প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অ্যামেরিকায় চলছে বিক্ষোভ। কখনোকখনো রূপ নিচ্ছে পুরোদস্তুর লুটিং আর দাঙ্গায়। এর মধ্যে মারা গেছে একজন, আহত অনেক। ভাঙচুর করা হয়েছে অসংখ্য গাড়ি আর দোকানপাট। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। মিনিঅ্যাপোলিসে একটা পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সিএনএন অফিসেও আগুন লাগানো চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করছে। বিক্ষোভকারীদের ওপর গাড়ি তুলে দেয়ার ফুটেজ আসছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ন্যাশনাল গার্ডকে ডাকা হয়েছে কয়েক জায়গায়। কারফিউ দেয়া হয়েছে বেশ কিছু শহরে। ওয়াইট হাউসের সামনে ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা করার সময় সিক্রেট সার্ভিসের সাথে সঙ্ঘর্ষ হয়েছে বিক্ষোভকারীদের। ট্রাম্প টুইট করছে বলছে, ‘যখন লুট করা শুরু হবে, তখন শ্যুট করা শুরু হবে।’ বিক্ষোভের মূল কেন্দ্র মিনেসোটার ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক সেইফটি বলছে শহরে চলা “আরবান ওয়ারফেয়ার” নিয়ন্ত্রন করার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল তিনগুণ করা হয়েছে।
দৃশ্যগুলো বিশ্বের ‘একমাত্র সুপারপাওয়ার’ এর ‘সভ্য মানুষদের’ শহরগুলোর রাস্তার বদলে ‘তৃতীয় বিশ্বের’ সাথেই যেন বেশি মানানসই। অঘটনঘটনপটিয়সী ২০২০ এ, লকডাউনে আটকে পড়া বিশ্ববাসীর সামনে যেন বিচিত্র কোন ট্র্যাজিকমেডি হিসেবে হাজির হয়েছে অ্যামেরিকার #রায়ট_২০২০
ঘটনার শুরু ২৫শে মে। মিনিঅ্যাপোলিস মিনেসোটায়। এক দোকানে ২০ ডলারের জাল নোট চালানোর চেষ্টা করে ৪৬ বছর বয়েসী জর্জ ফ্লয়েড। দোকানের লোকজন পুলিশ ডাকে। চারজন পুলিশ অফিসার যখন এসে পৌছায় ফ্লয়েড তখন তার গাড়িতে। তাকে গাড়ি থেকে বের করা হয়। পুলিশের দাবি অনুযায়ী ফ্লয়েড এসময় বাধাঁ দেয়ায় তাকে মাটিতে উপুড় করে শোয়ানো হয়। উপুড় হয়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডের গলার পেছনে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন। বেশ কয়েকবার গলা থেকে হাটু সরিয়ে নেয়ার জন্য মিনতি করে ফ্লয়েড। এক পর্যায়ে বলে, ‘আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে’। তিন মিনিট পর নিস্তেজ হয়ে যায় ফ্লয়েডের শরীর। তবু আরো প্রায় ছয় মিনিট ধরে ফ্লয়েডের গলায় হাঁটু চেপে রাখে ডেরেক শভিন। পথচারীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে বাকি তিনজন পুলিশ অফিসার। প্যারামেডিকরা যতক্ষণে এসে পৌছায় ততোক্ষণে জর্জ ফ্লয়েড মারা গেছে। পুরো ঘটনা ভিডিও করে পথচারীরা। অনেকে সরাসরি স্ট্রিম করে ফেইসবুক লাইভে। ভিডিও থেকে পরিস্কার, জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের হাতে খুন হয়েছে। খুব দ্রুত ভাইরাল হয় ভিডিও। বিক্ষোভ ছড়িয়ে বিভিন্ন শহরে। শুরুতে শান্তিপূর্ণ থাকলেও, খুব তাড়াতাড়ি বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে।
ফ্লয়েড আর শভিন পূর্ব পরিচিত ছিল। একসময় দুজন বাউন্সার হিসেবে কাজ করেছে একই ক্লাবে। শভিনের আচরণের পেছনে ব্যক্তিগত মোটিভ থাকতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ হবার কারণেই সাদা পুলিশ এতো নির্বিকারভাবে জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করতে পেরেছে, একথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে অ্যামেরিকান পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা এবং বিচার ব্যবস্থার একচোখা নীতির ইতিহাস বেশ পুরনো। পুলিশের এমন আগ্রাসন আর খুনের ঘটনাও নতুন না। গত কয়েক বছর যাবত এধরনের বেশ কিছু ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়, কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে চলা সিস্টেম্যাটিক সহিংসতা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিএলএম (ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার) আন্দোলনের ব্যানারে বারবার বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তাদের সাথে এসব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে বিভিন্ন বামঘেষা দল, বিশেষ করে উগ্র ও সহিংস অ্যান্টিফা (Antifa – Anti Fascist)। এবারো বেশিরভাগ ভাঙচুর এবং সহিংসতা করছে অ্যান্টিফার লোকজন। অনেক ফুটেজে দেখা যাচ্ছে কালো অ্যাক্টিভিস্টরা, অ্যান্টিফার সদস্যদের ভাঙচুর থামানোর ব্যার্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
গত বেশ ক বছর ধরে বাড়ছে অ্যামেরিকার সাদা আর কালো মানুষদের মধ্যে দূরত্ব। বাড়ছে সমাজের মেরুকরণ। কালোরা মনে করছে এতো বছর পরও তারা শোষিত, অধিকারবঞ্চিত। নিয়মতান্ত্রিক বর্ণবাদ আর নির্যাতনের স্বীকার। তাদের সাথে আছে বামপন্থী, সমকামী আন্দোলন, ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলন, এবং জর্জ সরোসরা। অন্যদিকে ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের খরচ যোগাতে গিয়ে আর এক যুগ আগের মন্দার প্রভাবে মধ্যবিত্ত সাদা অ্যামেরিকানদের অবস্থাও এখন ভালো না। বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, সামাজিক অবক্ষয়, নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ওরাও এখন ক্রুদ্ধ। হঠাৎ করে সাদাদের মনে হচ্ছে নিজ দেশে ওরা উপেক্ষিত। এই ক্রোধকে উইপেনাইয করছে স্টিভ ব্যাননরা। দুই পক্ষের এই ক্রোধে ঘি ঢালছে ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকানদের নির্বাচনী রাজনীতি। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার থেকে শুরু করে অ্যান্টিফা পর্যন্ত সব ধরণের আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বেশ কয়েক দশক ধরে অভিবাসী, অশ্বেতাঙ্গ এবং অ-খ্রিস্টান অ্যামেরিকানদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা ডেমোক্রেটরা। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত, ওয়ার্কিং ক্লাস ক্রিশ্চিয়ান, সাদা অ্যামেরিকার ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে রিপাবলিকানরা। ২০১৬ তে ট্রাম্পের বিস্ময়কর বিজয়ের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল সাদা অ্যামেরিকার এই ক্রোধের। উত্তেজনার পালে আরও হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে সবসময় রেটিং বাড়ানোর ধান্ধায় থাকা মিডিয়া। ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই দুই ক্যাম্পের সামরিকায়ন ঘটছে।
অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন হতেই পারে। অ্যামেরিকাতেও ষাটের দশকে সিভিল রাইটস আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এখন যা ঘটছে তা নিছক আন্দোলনের চেয়ে গভীর কিছুর ইঙ্গিত দেয়। কৃষাঙ্গ অ্যাকাডেমিক, হার্ভার্ডে দর্শনের প্রফেসর, এবং পলিটিকাল অ্যাকটিভিস্ট করনেল ওয়েস্ট সিনএনএন-এ এসে বলছে, “আমরা এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌছেছি যেখানে আমাদের হয় অহিংস বিপ্লব বেছে নিতে হবে, যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা, সম্পদ, সম্মান, এবং রিসোর্স ভাগাভাগি ও অংশীদারিত্ব কায়েম হবে। অথবা আমরা এমন আরো সহিংসতার বিস্ফোরণ দেখবো…আমরা আজ সামাজিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে অ্যামেরিকার ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করছি। আমাদের বুঝতে হবে আমরা এমন এক মূহুর্তে বসবাস করছি, যখন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিরাষ্ট্র জনগণের নিরাপত্তা এবং অধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়েছে”।
সারা পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্র, লিবারেলিসম আর ‘অ্যামেরিকান ড্রিম’ রপ্তানী করে বেড়ানো অ্যামেরিকাতেই আজকে অ্যামেরিকার সিস্টেমের ব্যর্থতার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। অ্যামেরিকান ড্রিম অনেক আগেই পরিণত হয়েছে অ্যামেরিকান নাইটমেয়ারে অ্যামেরিকানরাও বেশ কিছুদিন আগে থেকে তা অনুভব করলেই সবেমাত্র তা উপলব্ধি করতে শুরু করছে। নিজ সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। সাম্রাজ্য হিসেবে অ্যামেরিকার যে অবধারিত পতনের পর্যায় শুরু হয়েছে এই উপলব্ধি, এই উচ্চারণ, এই হত্যা, এই দাঙ্গা তার উপসর্গ। এবং যতো সময় যাবে উপসর্গ ততো তীব্র হবে। না…এখনই অ্যামেরিকার পতন হবে না। সাম্রাজ্যের পতন এক দিনে হয় না। সময় লাগবে। তবে নিঃসন্দেহে পতন হবে। আর পতনের পর্যায়ে সহিংস বামপন্থী আর শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা একে অপরকে উস্কে দিতে থাকবে, ক্রমেই বাড়বে মেরুকরণ এবং সহিংসতা। এই আসন্ন সংঘাতের গতিপথ নিয়ে চিন্তাপরাধ-এর শ্বেত সন্ত্রাস প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি –
“পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট যখন আসবে তখন তা পশ্চিমা বিশ্বে রাতারাতি তৈরি করতে পারে এক বিশাল বেকার শ্রেণি–যারা মধ্যবিত্ত, শ্বেতাঙ্গ এবং ক্রুদ্ধ। লিবারেল আদর্শের ঐক্য, বহুত্ববাদ, সম্প্রীতির বড় বড় বুলিগুলো ফাঁকা পকেটে আর খালিপেটে তাদের কাছে অর্থহীন মনে হবে। নিজেদের চাকরিগুলো ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তারা দায়ী করবে চোখের সামনে হেঁটে বেড়ানো রংবেরঙের অভিবাসীদের, এবং তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ থাকবে ‘বর্বর’, ‘সন্ত্রাসী’, ‘আগ্রাসী’ মুসলিমদের ওপর। অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘু এবং ভিনদেশিদের প্রতি জনবিদ্বেষ তৈরি করে তা নিয়ে বেঞ্জামিন ফ্রিডম্যানসহ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা আলোচনা করেছেন। এ ধরনের বিদ্বেষের ফলে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে ইতিহাসজুড়ে বারবার জন্ম নিয়েছে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা, সন্ত্রাস এবং যুদ্ধ। শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি এ ধরনের প্রেক্ষাপট চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (BLM) এবং অ্যান্টিফা (Antifa) এর মতো বামপন্থীদের কিংবা পরিবেশবাদী আন্দোলনগুলোকে। এ ধরনের দলগুলোর মধ্যে এরই মধ্যে দেখা গেছে সীমিতমাত্রায় শক্তি ব্যবহারের প্রবণতা। এ ধরনের আন্দোলনগুলো হয়তো বৈশ্বিক পর্যায়ে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে অ্যামেরিকাতে, এগুলোর অস্তিত্ব এবং কার্যক্রম প্রকট করতে পারে সামাজিক মেরুকরণ ও শ্বেতাঙ্গদের আত্মপরিচয়ের সংকটকে। এ দ্বন্দ্ব জিইয়ে থাকলে বাড়বে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সমর্থন, প্রচার ও প্রসার।
অর্থনৈতিক সংকটের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক মেরুকরণ, সামাজিক অস্থিরতা এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে চরমপন্থার মিশেল জন্ম দিতে পারে এক নিখুঁত রুদ্র ঝড়ের। সেই ঝড় মোকাবেলা করার ক্ষমতা লিবারেলিযমের ফাঁপা আদর্শের নেই। যখন পেটে লাথি পড়বে, সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করবে তখন সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বাণী দিয়ে উন্মত্ত জনতার স্রোত থামানো যাবে না।” (শ্বেত সন্ত্রাস, চিন্তাপরাধ)