মোদি, বিজেপি, আরএসএস – এদেরকে তুচ্ছাতাচ্ছিল্য করার একটা প্রবণতা আমাদের আছে। এই লোকগুলো কেবল জান্তব ঘৃণাচালিত, এরা সারাক্ষণ দাঙ্গা লাগাবার কথা চিন্তা করে আর অবসর সময়ে গোবরের কেক আর গো-মূত্রের ড্রিংক তৈরিতে ব্যস্ত থাকে – আমরা সম্ভবত এরকম কিছু একটা ধরে নিতে পছন্দ করি। এ ধরনের চিন্তা শুধু যে ভুল তা না, বরং বিপদজনক। আরএসএস এবং সহযোগী সংগঠনগুলো উন্মাদ না, তারা র্যাশনাল অ্যাক্টর। সেই সাথে তারা একটা আদর্শিক আন্দোলন, যার ভিত বেশ শক্ত।
আমরা এখনো পর্যন্ত যা যা দেখেছি, সেগুলো তবলার ঠুকঠাক। মূল বাজনা এখনো বাকি। বিজেপি-আরএসএস এর মত্ততার পেছনে পরিকল্পনা আছে। আমাদের কাছে যাই মনে হোক না কেন, বাস্তবতা হল, তারা এলোপাথাড়ি কিছু করছে না। তারা কাজ করছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে। CAA বা নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে এখন বেশ হইচই হচ্ছে। এই CAA (নাগরিকত্ব সংশোধন আইন) এবং এর সাথে জড়িত NRC (নাগরিকপঞ্জী) – নিয়ে বিজেপির এন্ড গেম কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বিপদটা বোঝা যাবে।
বিজেপির একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য হল ভারতের যেসব রাজ্যে সাধারণত তারা জেতে না, সেখানে নিজেদের ভোট বাড়ানো। তারা চায় আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় জম্মু, পাঞ্জাব, এবং বিশেষভাবে পশ্চিম বঙ্গে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রধান টার্গেট হল পশ্চিমবঙ্গে জিতে আসা। বিজেপির হিসেব অনুযায়ী জেতার চাবিকাঠি হল এসব রাজ্যের অমুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের (যেমন নিম্নবর্ণের হিন্দু, দলিত, শিখ) নাগরিকত্ব দিয়ে নিজেদের অনুগত ভোটারে পরিণত করা।
অন্যদিকে আরএসএস-এর ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যগুলোর একটা হল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের মুসলিমের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত করা। এটা হিন্দুত্ববাদী দর্শনের প্রধান এবং পুরনো লক্ষ্যগুলোর একটি। হিন্দুতভা দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাভারকার, প্রায় একশো বছর আগে বলেছিল, ভারতবর্ষে মুসলিমদের থাকতে হলে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। এনআরসি-র পেছনে বিজেপির মূল উদ্দেশ্য হল ভারতের মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে, তাঁদের নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকার বাতিল করা। এর ফলে ভারতের মুসলিমর কার্যত দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত হবে।
অর্থাৎ দুটো লক্ষ্য আমরা পাচ্ছি –
মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করা
রিফিউজি অমুসলিমদের (বিশেষ করে নিম্নবর্ণ ও দলিত হিন্দুদের) নাগরিকত্ব দিয়ে অনুগত ভোটার বানানো।
কিন্তু সমস্যা হল শুধু এনআরসি দিয়ে এ লক্ষ্যে পৌছানো যাবে না। ভারতের অধিকাংশের মানুষের পক্ষে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো দেখানো সম্ভব না। আর এনআরসি করলে বাদ পড়ে যাবে হিন্দু রিফিউজিরাও। যার প্রমাণ আমরা আসামে দেখেছি। অগাস্টে প্রকাশিত আসামের নাগরিকপঞ্জিতে ১৯ লক্ষ ‘অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু নাগরিকত্ব হারানো এই ১৯ লক্ষের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ হল হিন্দু। এটা বিজেপির জন্য একটা বড় সমস্যা। এমন হলে নতুন ভোট পাওয়া তো দূরের কথা, ভোট আরো কমবে। তাহলে সমাধান কী?
সমাধান হল নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। এনআরসির মাধ্যমে যেসব অমুসলিমরা নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়বে, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে তাদের আবার নাগরিকত্ব দেয়া হবে। এভাবে একদিকে মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল হল, অন্যদিকে হিন্দু রিফিউজিদের মধ্যে শক্ত ভোটব্যাংকও হল। একারণেই ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে পুরো ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে বিজেপি। কিন্তু হিসেব এখানেই শেষ না।
ভারতে রাজ্যপ্রতি মুসলিম জনসংখ্যার হার সবচেয়ে বেশি হল জম্মু-কাশ্মীর, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায়। আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির লোক। জম্মু-কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থার কথা আমরা সবাই জানি। বাকি থাকে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা। যদি পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় জিততে পারে, তাহলে লোকসভায় বিজেপির ব্রুট মেজরিটি থাকবে, মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর কর্তৃত্বও তাদের হাতে থাকবে (ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানাতে বিজেপি ক্ষমতায়), আর সুপ্রিম কোর্ট তো তাদের অনুগতই। এমন পরিস্থিতিতে, পরবর্তী মেয়াদ (২০২৪) নাগাদ সুপ্রিম কোর্টের সহায়তায় হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সাংবিধানিকভাবে তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে।
এ পরিকল্পনা কি এভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব? আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। তবে আপাতভাবে কিছু সম্ভাবনা সোজাসাপ্টাভাবে বোঝা যায়।
প্রথমত, আগামী দু বছরে ভারতজুড়ে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, খুব জোর দিয়ে এনআরসি নিয়ে কাজ করবে। প্রথম ধাপ হিসেবে NPR (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার) এর কাজ শুরু হবার কথা ২০২০ এর এপ্রিলে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে চলবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার উৎসব।
দ্বিতীয়ত, বিজেপির পরিকল্পনা সফল করতে হলে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণকে আরো তীব্র মাত্রায় নিয়ে জেতে হবে। এবং ইতিহাস বলে এধরনের মেরুকরণের প্রক্রিয়াটা শুকনো থাকে না, লাল রঙ্গে ভিজে যায়।
তৃতীয়ত, ভারতের অর্থনীতির অবস্থা আশঙ্কাজনক, সম্ভবত বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। পেটে লাথি পড়লে সমাজে মেরুকরণ এবং সহিংসতার মাত্রা বাড়ে। সম্প্রীতি, উদারতা, এসব সেক্যুলার বোল তখন তেমন একটা পানি পায় না। আর এধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার দিক দিয়ে আরএসএস এর অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ।
চতুর্থত, এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলে।
পঞ্চমত, যে পরিস্থিতি সামনে আসছে তার মোকাবেলার কোন সক্ষমতা কিংবা প্রস্তুতি আমাদের নেই। এখানে ‘আমাদের’ – কথাটা ব্রডেস্ট সেন্সেই বললাম। বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ তো বটেই, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদেরও এ নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা নেই। ইসলামপন্থীরা ব্যস্ত পতাকাপ্রিন্টের জুব্বাটুপি নিয়ে।
বুদ্ধিমানরা ঘটনার আগে পরিকল্পনা করে। বোকারা ব্যস্ত থাকে প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আমরা বরাবরই কোন শ্রেণীতে পড়ে আসছি সেটা স্পষ্ট। এবং আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী।