প্রথমে একটা সত্য আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। এমন এক সময়ে আমরা বাস করছি যখন মুসলিমরা পরাজিত ও দুর্বল। আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। ফিরিঙ্গি দখলদার আমাদের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে পিঠে পুঁজিবাদ তুলে দিয়েছে। অস্ত্রের জোরে পশ্চিমা সভ্যতা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তাদের ধ্যানধারণা, পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান। স্বেচ্ছায়, স্বাধীনভাবে আমরা এগুলো গ্রহণ করিনি। সেই সুযোগই আমরা পাইনি। আমরা সাম্যবস্থায় নেই, বরং জাতি হিসেবে আমরা বসবাস করছি ভারসাম্যহীনতার এক পর্যায়ে। মুসলিম হিসেবে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বগুলো আমরা পালন করতে পারছি না। জাতি হিসেবে আমাদের যে মহান দায়িত্ব – মানবজাতিকে সত্যের দিকে আহ্বান করা, সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করা, অন্যান্য জাতিগুলোকে ইসলাহ করা, পথ দেখানো – তার কোনটিই আমরা ঠিকমতো করতে পারছি না। বরং বলা যায় আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের ইসলামী পরিচয় এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন শত্রুর বিভিন্ন ধরণের আক্রমণের মোকাবেলায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক সংঘাতে আমরা ব্যস্ত ও বিপর্যস্ত।
এ সত্যটি আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে পশ্চিমা দর্শন, পদ্ধতি, জ্ঞানতত্ত্ব ইত্যাদির ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয় ঠিক করার আগে। পরাধীনতার সময়ে এ বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসলে ফলাফল ভুল হবেই। মুসলিমদের পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তর করার প্রশ্ন প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি বিষয়ে আমাদের চিন্তা ও বিশ্লেষণের মাপকাঠি হতে হবে । উম্মাহর সামগ্রিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোন একটি বিষয় নিয়ে সংকীর্ণ পরিসরে চিন্তা করার বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ আমাদের নেই। আমাদের চিন্তা করতে হবে মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা ও উম্মাহর বিজয় – এর কতটুকু এই ধরণের ইসলামীকরনের মাধ্যমে অর্জিত হবে। একইসাথে আমাদের শরীয়াহর আলোকে যাচাই ও বিশ্লেষণ করতে হবে এ ধারণাগুলোর মূলনীতি তথা ফার্স্ট প্রিন্সিপালসগুলোকে। এ দুইধাপে সমস্যা না পাওয়া গেলে, তখন এবং কেবলমাত্র তখনই খুটিনাটির আলোচনায় যাওয়া হবে। এই ধাপগুলোকে টপকে ব্যাংকিং কিংবা ফাইন্যান্স এর কতোটুকু “ইসলামী”, কোন কোন বিষয়কে কতোটুকু বদলে নিলে এগুলোকে “শরীয়াহসম্মত” বা “শরীয়াহ কমপ্লায়েন্ট” করা যাবে – শুধু এই সংকীর্ণ ও সাময়িক প্রয়োজনের চিন্তায় সবসঅময় আবদ্ধ থাকলে পরাধীনতার এ পর্যায় থেকে কখনোই বের হওয়া যাবে না। কেবল ধরে ধরে সবকিছুর আগে “ইসলামী” ট্যাগ লাগিয়ে সাথে কিছুটা “ইসলামী মেইকাপ” করিয়ে দিলে হবে না।
বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতার শুরুটা আমরা খুঁজে পাবো আজ থেকে চার বা পাঁচশো বছর আগে। আর কলোনিয়ালিযমের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ওপর এ সভ্যতার কতৃত্ব অর্জন করতে শুরু করে সপ্তাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। ডিসাইসিভভাবে ১৯২৪ এ উসমানী সালতানাতের পতনের মাধ্যমে পরাজয়টা সম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট হয় । এই অর্থে গত শতাব্দীকে ইসলামী সভ্যতার ওপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও পশ্চিমা সভ্যতার বিজয়ের সময় ধরা যায়। পশ্চিমা আগ্রাসন – আদর্শিক কিংবা সামরিক – মোকাবেলার যেসব মুভমেন্ট আমরা বর্তমানে দেখি তার সবগুলোর শুরু মোটামুটি এই টাইম পিরিয়ডের মধ্যে। ইন্টারেস্টিংভাবে প্রায় অঞ্চলেই প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মুসলিমদের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল সামরিক। বিভিন্ন কারণে সামরিক প্রতিরোধের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আমরা অন্যান্য বিভিন্ন পদ্ধতির খোঁজ করা শুরু করি। আর এ সময়টাতেই আমাদের মধ্যে জেঁকে বসতে শুরু করে আগ্রাসনের মোকাবেলায় আপসকামীতাকে একটি চিন্তাগত ও দার্শনিক কাঠামো দাড় করিয়ে একে বৈধতা দেয়ার প্রবণতা।
মোটা দাগে এই প্রবণতার দুটো ধরণ দেখা যায়। একটি হল পশ্চিমা সভ্যতা ও পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার আলোকে ইসলামকে পুনঃসংজ্ঞায়িত বা পরিবর্তন করার চেষ্টা। একে আমরা ইসলামি মর্ডানিযম বা মর্ডানিস্ট মুভমেন্ট বলতে পারি। আর অন্যটি হল, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার ইসলামীকরন। একে আমরা ইসলামি রিভিশনিযম বা রিভিশনিস্ট মুভমেন্ট বলতে পারি। বর্তমানে “উম্মাহর উত্তরণের পন্থা” হিসেবে যেসব পদ্ধতিকে খুব জোরেশোরে প্রচার করা হয়, যেগুলোকে “গ্রহণযোগ্য” ও “বাস্তবসম্মত” মনে করা হয়, তার সবগুলোই মোটাদাগে এ দুই ধরণের চিন্তার ফসল। এই দুই ধরণের চিন্তার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও গুরুত্বপূর্ন কিছু মৌলিক মিলও আছে। যেমন মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে কোন সংঘর্ষকে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে আবশ্যিক তো মনে করাই হয় না, বরং তারা এ ব্যবস্থার সাথে আপোষের দিকে অন্যান্যদের আহ্বান করে।
মর্ডানিস্ট ও রিভিশনিস্ট মুখে যাই বলুক না কেন তাদের কাজ ও প্রস্তাবনা প্রমাণ করে যে তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থাকে স্থায়ী মনে করেন। তারা আসলে মনে করেন না যে বর্তমানে দ্বীনের পরিপূর্ণ বিজয় এবং উম্মাহর পক্ষে সালাফ আস-সালেহিনের মতো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব। এটা তারা চিন্তাও করেন না যে এ বিশ্বব্যবস্থার আদৌ পতন হতে পারে। তাই কিভাবে এ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে কিছু সাময়িক অর্জন পাওয়া যায়, তাদের সব গবেষনা সেটাকে ঘিরেই। গত দুই শতাব্দী জুড়ে ফিরিঙ্গী ক্রুসেইডার ও যায়নিস্টদের হাতে আমরা যে পরাজয়ের শিকার হয়েছি, তাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত সেই পরাজয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত। তাই তাদের সব প্রস্তাবনা হল পশ্চিমের সাথে মানিয়ে নেয়া, বর্তমান অবস্থায় সহাবস্থান ও পশ্চিমা বিভিন্ন ধ্যানধারণা গ্রহণ করার জন্য হয় ইসলামকে পরিবর্তন করা অথবা ইসলামিকরনের। গণতন্ত্র, ব্যাংকিং, সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, জাতিসংঘ কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা, ফেমিনিযম, হিউম্যান রাইটস, মুক্তচিন্তাসহ পশ্চিমে চিন্তার বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে তাদের চিন্তা ও অবস্থান এ দুটোর যেকোন একটির মধ্যে পড়বে। মিলিয়ে দেখুন। আর তাদের নিজেদের মধ্যে পার্থক্য হল আপোসের ধরনে। মর্ডানিস্ট হয়তো আপনাকে বলবে – ব্যাংকিং জায়েজ কারণ একটা নির্দিষ্ট পারসেন্টেজ পর্যন্ত “ইন্টারেস্ট” আসলে কুরআনে বর্ণিত রিবা না। অন্যদিকে রিভিশনিস্ট আপনাকে বলবে – ইসলামী ব্যাংকিং জায়েজ, কারণ ইসলামী ব্যাংক যেটা দেয় ও নেয় সেটা “মুনাফা, রিবা না।
আসলে এই অ্যাপ্রোচে কখনো ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। কারণ দাবিগুলো সরিয়ে বাস্তবতার দিকে তাকালে দেখবেন ইসলাম প্রতিষ্ঠা আদৌ এ “সমাধান” গুলোর উদ্দেশ্যই না। নিজের অজান্তেই তারা এমন সব “সমাধান” দিচ্ছেন যার শেষ কথা হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার অধীনস্ত হওয়া। এধরণের চিন্তা উম্মাহর লাভের বদলে বরং ক্ষতিই করে, কারণ প্রতিটি এমন পদক্ষেপ উম্মাহকে উত্তরণের সঠিক পথ থেকে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে পশ্চিমের দাসত্বের গর্তের আরো গভীরে নিয়ে যায়। ইসলামীকরন কিংবা ইসলামী চিন্তার পরিবর্তনের সাথে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কী সম্পর্ক? এর সম্পর্ক তো আত্মরক্ষা, নিজেকে প্রবোধ দেয়া আর সাময়িক অর্জনের সাথে। মর্ডানিস্ট ও ইসলামীকরনের গান শোনানো রিভিশনিস্টরা আজো ঐসময়ের উপসংহার আওড়ে যান, যখন এ বিশ্বব্যবস্থাকে অজেয় মনে করা হত। পতনোন্মুখ এ ব্যবস্থার অবক্ষয় ও অধঃপতন সম্পর্কে বেখেয়াল তারা আজো বসবাস করেন গত শতাব্দীতে।
কোন জীবনব্যবস্থা ও সভ্যতার বিজয় কখনো শুধু অনুকরনে, বই পড়ে লিখে, ইলমী, দাওয়াতি কিংবা আধ্যাত্মিক কাজের মাধ্যমে আসে না। এমনকি যে সভ্যতাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখানো হচ্ছে সে পশ্চিমা সভ্যতার বিজয়ও এভাবে আসেনি। জাতি ও সভ্যতাগুলোর উত্থান ও পতনের ইতিহাস এর সত্যবাদী সাক্ষী। দখলদারের অনুকরণে বিজয় আসবে না, সেটাকে যতোই ইলমী, ইসলামী কিংবা ইন্টেলেকচুয়ালিটির পোশাক পরানো হোক না কেন। বিজয় সে পথেই আসবে যে পথে মক্কা বিজয় হয়েছিল। এ সত্য অনুধাবন করতে না পারলে আমরা কেবল ব্যার্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খেতে থাকবো। আর যখন সময় হবে যারা এ সত্য যারা অনুবাধন করবে, যারা ওহীর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে তাঁদের মাধ্যমে আমাদের প্রতিস্থাপন করা হবে।