ইসলামে আসার আগে আমার পছন্দের সাবজেক্টগুলোর একটা ছিল সিরিয়াল কিলিং। টেড বান্ডি, জেফরি ডাহমার, এডমান্ড কেম্পার, গ্রিন রিভার কিলার – একটা অদ্ভূত আগ্রহ কাজ করতো এই মানুষগুলোকে নিয়ে। ইন ফ্যাক্ট এখনো কাজ করে, তবে এখন লাগাম দেয়ার চেষ্টা করি। আশির দশকের নন্দিত হেনরি – প্রট্রেইট অফ আ সিরিয়াল কিলার, নব্বইয়ের সাড়া জাগানো সাইলেন্স অফ দা ল্যাম্বস, কিংবা নতুন সহস্রাব্দের ডেক্সটার, হ্যানিবল বা মাইন্ডহান্টার – সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে মিডিয়ার (এবং বিশ্বজুড়ে দর্শকদের) আগ্রহও প্রচুর। কিন্তু সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে আমাদের আগ্রহের কারণটা কী? আকর্ষনটা কোথায়?
অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারের ক্ষেত্রে অপরাধটা একটা লম্বা প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ। ভিকটিম এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। “ক” বা “খ”-কে খুন করাটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ন হল সিরিয়াল কিলারের অবসেশন, তার ফ্যান্টাসি বাস্তবায়ন করা। এই ফ্যান্টাসির জগতটা যদিও আমরা দেখি না, কিন্তু যখন শুনি জেফরি ডাহমার যখন তার ভিকটিমের মাথার খুলি দিয়ে শোপিস বানানোর চেষ্টা করে, টেড বান্ডি যখন ভিকটিমের মৃতদেহ গলতে শুরু করার আগ পর্যন্ত “লাশের সাথে সেক্স” করে – তখন আবছা আবছাভাবে এ জগতের টুকরো টুকরো কিছু ছবি আমরা দেখতে পাই।
গা ঘিনঘিন করে, কিন্তু একই সাথে অদ্ভূত একটা আকর্ষন কাজ করে। জানতে ইচ্ছে করে, এই জীবটা দেখতে কেমন? কীভাবে কথা বলে? এক সাথে চা খাবার সময় লোকটা কী নিয়ে আলোচনা করতে পারে? আর সবকিছু ছাপিয়ে সিরিয়াল কিলারদের যৌন বিকৃতি, অসুস্থতা, এবং তাদের অপরাধের বীভৎসতা আমাদের আকৃষ্ট করে। বাংলায় যুতসই কোন প্রতিশব্দ হয় না, এমন দুটো শব্দ দিয়ে এ আকর্ষনকে প্রকাশ করা যায়। গ্রোটেস্ক (Grotesque) এবং মাকাঁব (Macabre). এই আকর্ষনের একটা ইউটিলিটি (Utility – উপযোগ) আছে।
যদি শুনেন রোড অ্যাক্সিডেন্টের পর এক লোকের কোমরের নিচের অংশ উড়ে গেছে, কিন্তু লোকটা এখনো বেঁচে আছে, আপনি কি দেখতে যাবেন? আর যদি শুনেন কোন রাস্তার মাঝখানে মানব বর্জ্যের মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে? দুটো দৃশ্যই অসুস্থ। কিন্তু প্রথম অসুস্থতাকে ঘিরে জটলা একটু বড় হবে। কিছু অসুস্থতা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা অসুস্থ কৌতূহল কাজ করে। একারণেই ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো কিছু নির্দিষ্ট ধরনের খবরের ওপর ফোকাস করে। খুন, ধর্ষন, পরকীয়া, গোপন ভিডিও ইত্যাদি। পত্রিকাওয়ালারা বোঝে মানুষ কোন এক কারণে এ বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহবোধ করে।
কিছুদিন আগে পাকিস্তানে বেশ ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। যায়নাব আনসারি নামের ছয় বছরের একটা মেয়ে কুরআন তিলাওয়াতের মাহফিলে যাবার সময় হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, জ্যাকেট পড়া অচেনা এক লোকের হাত ধরে হেলেদুলে যায়নাব এগিয়ে যাচ্ছে। ৫ দিন পর যায়নাবের রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া যায় ডাস্টবিনে। ধর্ষনের পর যায়নাবকে গলা টিপে মারা হয়েছিল। প্রায় দু সপ্তাহ পর যায়নাবের হত্যাকারী ইমরান আলি ধরা পড়ে। যায়নাবসহ ইমরানের মোট ভিক্টিমের সংখ্যা ৮।
আমার স্ত্রী খুব মনোযোগ দিয়ে পুরো খবরটা ফলো করছিল। প্রায়ই আমাকে আপডেট দিতো। আমি যথাসম্ভব কম মনোযোগ দিয়ে শোনার, এবং যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার চেস্টা করতাম। কেন করতাম, ব্যাখ্যা করছি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে, আমার বদ্ধমূল ধারণা ছেলে এবং মেয়েরা একই সমস্যা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে অ্যাপ্রোচ করে। আমি যখন কোন সমস্যার কথা শুনি, আমার মাথায় প্রশ্ন আসে – কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়? (What is to be done?)। একজন মেয়ে যখন একই সমস্যা দেখে তার মাথায় প্রশ্ন আসে – এ ঘটনাটা জানার পর তোমার কেমন লাগছে? (How do you feel?)
আমার মতে প্রথম প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে সাহায্য করবে সমস্যাকে বুঝতে এবং সমাধান খুজে বের করতে। অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। এ উত্তর জানা আমাদের কোন কাজে আসে না। অবশ্যই আপনার বা অন্য যে কারো ইমোশান গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ইমোশান দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না।
যায়নাবের জন্য আমার স্ত্রীর দুঃখটা মেকি না। ইন ফ্যাক্ট যে কোন মানুষ পাঁচ মিনিট বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করলে, যায়নাবের হাসিখুশি ছবিগুলোর দিকে তাকালে, নিজের ভেতরে তীব্র কষ্ট অনুভব করবে। কিন্তু প্রশ্ন হল এই কষ্ট কি আমার কোন কাজে লাগছে? এই কষ্ট কি যায়নাবদের রক্ষা করবে? যদি না লাগে, তাহলে ধর্ষনের প্রশ্নে, অপরাধের প্রশ্নে এই ইমোশানের মূল্য কী? নিশ্চিতভাবেই ইমোশান আমাদের সমাধান দেবে না। তাই না? ব্যাপারটা বোঝা জটিল কিছু না। সহজ সমীকরন। বাসায় যদি আগুন লাগে, তাহলে আগুন লাগার ফলে “আমার অনুভূতি কী” – এটা জেনে কারোরই তেমন উপকার হয় না।
যদি আপনি আসলেই কোন কোন সমস্যার সমাধান চান তাহলে সমস্যার উৎস, অনুঘটক এবং সমাধান খুজে বের করতে হবে। মানবজাতি যদি প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন নিয়ে পড়ে থাকতো তাহলে মানবসভ্যতা অগ্রগতি হতো না। আপনার অনুভূতি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাতে বাস্তবতা বদলায় না। বাস্তবতাকে বদলাতে হয়। আর যখন আপনি কোণ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, প্রথম প্রশ্নের জবাব খোঁজা ছাড়া বাকি সবকিছুই (আমার মতে) দুঃখ এবং কল্পনাবিলাস।
দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে বর্তমানে ধর্ষন নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তার ৯৯% এর বেশি বিভিন্ন মাত্রার অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে ফোকাসড। পোশাক, অথবা পোশাকের অভাবে, পুরুষ অথবা পুরুষতন্ত্র – এসব তো মূল প্রশ্ন না। মূল প্রশ্ন হল –
কিভাবে ধর্ষন বন্ধ করা যায়?
ধর্ষন সমস্যার সহজ সমাধান আছে। কিন্তু আপনি, আপনার সমাজ সেই সমাধান মানতে রাজি না। এটা কোন ব্যক্তির সমস্যা না, কোন লিঙ্গের সমস্যা না, পোশাকের সমস্যা না, এটা একটা সিস্টেমিক সমস্যা। ইসলাম আট ধাপে এ সমস্যা সমাধান দেয় –
১) নৈতিকতার শক্ত ভিত্তি। বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গ ও যৌনতার ব্যাপারে। এমন নৈতিকতা যা অপরিবর্তনীয়, যুগের সাথে সাথে যা বদলায় না।
২) স্ট্রিক্ট জেন্ডার সেগ্রেগেশান।
৩) পুরুষদের দৃষ্টি অবনত রাখা।
৪) নারীদের শার’ঈ পর্দার হুকুম মেনে চলা
৫) মাহরাম বা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের বাইরে চলাফেরা নিরুৎসাহিত করা
৬) পর্নোগ্রাফিসহ সব ধরনের হার্ডকোর ও সফটকোর এরোটিক বা যৌন উত্তেজক গান, ছবি, কথা বা চিত্রায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা।
৭) ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক ও দ্রুত শাস্তি কার্যকর করা।
৮) স্বচ্ছ বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
এটা হল পরিপূর্ণ সমাধান, যেটা সামগ্রিকভাবে আপনাকে রেসাল্ট এনে দেবে। কিন্তু যা বললাম। এ সমাধান আপনার পছন্দ হবে না। আপনি যদিও মুখে বলেন, আপনি সমাধান চান, কিন্তু আসলে সমাধানের যা করণীয়, আপনি তা করতে রাজি না।
আপনি রাজি না, কারন তাহলে আপনাকে বিপদজনক কিছু সত্যকে স্বীকার করে নিতে হবে। আপনাকে বিপদজনক কিছু সত্যের পক্ষে কথা বলতে হবে। আপনাকে স্বীকার করতে হবে সমস্যাটা সিস্টেমিক। তাই সমাধান আনতে হলে সিস্টেমকে বদলাতে হবে। মানবরচিত শাসনব্যবস্থা বদলে ইসলামী শারীয়াহ আনতে হবে। আর যে মূহুর্তে আপনি এ সত্য বিশ্বাস করা শুরু করবেন, বিশ্বের রাজা-বাদশাহদের কাছে আপনি শত্রু হয়ে যাবেন। অথব আপনার নিজের প্রবৃত্তিই আপনার বিরোধিতা শুরু করবে। কারন ইসলামী শারীয়াহ হয়তো আপনার অনেক কামনা-বাসনার বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
তাই আপনি সমস্যার সমাধান খুঁজবেন না। সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রেইপের খবর পড়বেন। আপনি মূল প্রশ্নের জবাব খোঁজার চাইতে, হালকার ওপর ঝাপসা স্লোগানবাজি, কোন একটা স্পেসিফিক বিষয় নিয়ে ত্যানা প্যাঁচানো আর “আপনার অনুভূতি কী” জাতীয় আলোচনাতেই আটকে থাকবেন। আগাতে পারবেন না।
আর আপনি যদি সৎভাবে এ প্রশ্নের জবাব খুজতে রাজি না হন, বরং অন্যান্য আলোচনায় মেতে থাকেন, দিনের পর দিন পত্রিকার্য ফলো আপ করেন, টক-শো করেন, সভা-সেমিনার করেন, এই ক্যাম্পেইন, সেই ক্যাম্পেইন চালাতে থাকেন। তাহলে দুটো জিনিস প্রমান হয়, প্রথমত, সমস্যার সমাধান খোঁজার এবং মূল সমস্যার মুখোমুখি হবার সৎসাহস আপনার নেই। দ্বিতীয়ত, তারপরও ক্রমাগত এ বিষয় নিয়ে মেতে থাকা অসুস্থতা নিয়ে আপনার অসুস্থ আকর্ষনের প্রকাশ। এক ধরনের অসুস্থ বিনোদন বলা যায়। অসুস্থ সভ্যতার ফসল সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে বানানো বিনোদনের বক্স অফিস সাফল্যের মতো।