জামাল আবদুন নাসের ক্ষমতায় আসার দু বছর পর ১৯৫৪ থেকে মিশরে শুরু হয় এক দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। ইখওয়ানুল মুসলিমীনের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বন্দী করা হয়। তাঁদের ওপর চালানো হয় ভয়ঙ্কর নির্যাতন, যার মাত্রা ও তীব্রতা অল্প কিছু শব্দ কিংবা বাক্যে বোঝানো সম্ভব না। দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়ার পরও যা আজও অবিশ্বাস্য মনে হয়। এসব বন্দীদের মধ্যে ছিলেন ক্ষয়রোগে ভোগা পঞ্চাশোর্ধ একজন লেখক ও চিন্তাবিদ। হাজার হাজার বন্দীদের মধ্যে থেকে জামাল নাসের ও তার সরকারের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা ছিল অধিকাংশ সময় জেলের হাসপাতালে কাটানো জীর্নশীর্ন দেহের এ মানুষটি নিয়ে। সাইয়্যিদ কুতুব। চিন্তার যথেষ্ট কারনও ছিল।
চলতে থাকা গ্রেফতারি, নির্যাতন ও অপমানের মধ্যেই ১৯৫৭ সালে কায়রোর তুরা কারাগারে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ২১ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। জেলের হাসপাতালে বসে নিরন্তর লিখে যাওয়া সাইয়্যিদ কুতুবের ওপর এ ঘটনাগুলো গভীর প্রভাব ফেলে। রূঢ় এই বাস্তবতা এক অর্থে তাঁর জন্য (এবং বাই এক্সটেনশান আমাদের জন্য) উপকারী ছিল। যে পর্বতসম ভার নিজ কাধে তিনি তুলে নিতে যাচ্ছিলেন, ভুলে যাওয়া যে সত্যকে উম্মাহকে মনে করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তার স্পষ্ট উপলব্ধির জন্য বাস্তবতার এপিঠটা দেখা তাঁর দরকার ছিল। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী ঠিক এ সময়টাতে নাসেরের সরকার এবং এরকম অন্যান্যদের প্রকৃত রূপ, এবং শরীয়াহর আলোকে তাদের অবস্থান সম্পর্কে সব ভ্রান্তি তাঁর সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়।
বন্দী অবস্থাতেই সাইয়্যিদ কুতুব লেখেন ফী যীলালিল কুরআন এবং তাঁর অবিস্মরনীয় মা’আলিমু ফিত-তরীক (মাইলস্টোন্স)। তাঁর এ উপলব্ধি ও অনুধাবনকে তিনি প্রকাশ করেন এ দুটি রচনার, বিশেষ করে ‘মা’আলিম’-এর মাধ্যমে। যাইনাব আল-গাযালির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সাইয়্যিদ কুতুবকে কেন হত্যা করা হল? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘মা’আলিম ফিত-তারীক পড়ো।’ ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হবার ১ মাসের মধ্যেই মা’আলিম ফিত-তরীক (মাইলস্টোন্স) বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। তারপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। পরের ৫ মাসে শেষ হয় বইটির ৬টি সংস্করণ। তারপর আবারো নিষিদ্ধ করা হয় বইটি।
ঐতিহাসিক জাবির রিযক সাইয়্যিদ কুতুবের বন্দী জীবনের সময়কার অদ্ভূত এক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন[১]। এসময় সাইয়্যিদ কুতুবের সাথে থাকতেন আরেকজন অসুস্থ বন্দী। মুহাম্মাদ হাওয়্যাশ। জাবির রিযকের ভাষ্য অনুযায়ী – অসুস্থ হাওয়্যাশ এক রাতে স্বপ্নে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে দেখতে পান। স্বপ্নে হাওয়্যাশ দেখেন ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁকে বলছেন, ‘সাইয়্যিদকে বল, সে যা খুজছে আমার সূরাতে পাবে’।
অবধারিতভাবেই হাওয়্যাশ তাঁর এ স্বপ্নের কথা কুতুবকে জানান। সূরা ইউসুফ আল-কুরআনের ১২ তম সূরা। এই সূরার ৩৫ থেকে ৪১ আয়াতে এসেছে ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর বন্দিত্ব, তাঁর কারাগারের সাথী ও তাদের স্বপ্নের কথা। একজন মুসলিম বন্দীর স্বাভাবিকভাবেই এ আয়াতগুলোর কথা মনে হতেই পারে। তবে এক্ষেত্রে হয়তো আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারাগারের সাথীদের প্রতি ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর দাওয়াহর কথা, এবং এ আয়াতগুলোর আলোকে সাইয়্যিদ কুতুবের উপলব্ধি। ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাইয়্যিদ কুতুবকে হত্যা করা হয়। তাঁর সাথী মুহাম্মাদ হাওয়্যাশকেও একই শাস্তি দেয়া হয়।
কী ছিল এ বইতে? কুরআনে খুজে পাওয়া কোন সত্য প্রকাশ করার কারনে হত্যা করা হয় সাইয়্যিদ কুতুবকে? সূরা ইউসুফের নিচের আয়াতগুলো তর্জমা পড়ার পর মা’আলিম ফিত তরীকের আলোচনার দিকে তাকালে উত্তরটা স্পষ্ট হয় যায়।
“আমি আমার পিতৃ পুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকূবের মতবাদ অনুসরণ করি। আল্লাহর সাথে কোন বস্তুকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়, এটা আমাদের ও সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা।
হে কারাগারের সাথীরা, বহু সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন রব ভাল নাকি মহাপরাক্রমশালী এক আল্লাহ’?
তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যার ‘ইবাদাত করছ তা কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, যে নামগুলো তোমরা আর তোমাদের পিতৃ পুরুষরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ নাযিল করেননি।
আল্লাহ ছাড়া কোন বিধান দাতা নেই। তিনি আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া আর কারো ‘ইবাদাত করবে না, এটাই সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না”।
(সূরা ইউসুফ, আয়াত ৩৮-৪০)
[১] مذابح الإخوان فى سجون ناصر