তিন তালাক ও সেক্যুলারিসম


ভারতের সংবিধানে পাস হওয়া তিন তালাক বিলের পেছনে একটা ফ্যাক্টর নিঃসন্দেহে ইসলামের প্রতি তাদের চিরাচরিত বিদ্বেষ। তবে এটাই একমাত্র ফ্যাক্টর না। আজ দেখলাম দেওবন্দের মুফতি আবুল কাসেম নোমানী এই বিলকে ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ বলেছেন । তাঁর কথা শতভাগ সত্য। তবে সেক্যুলারিযমের মধ্যে ইসলামের জন্য ফাঁকফোকর খোঁজা অনেকেই যে বাস্তবতাটুকু ভুলে যান তা হল ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ করাটা সেক্যুলারিযমের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। সেক্যুলারিযমের মূল উদ্দেশ্যই হল সব ধর্মকে সরিয়ে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। সেক্যুলার দর্শনের জন্মই ধর্মের বিকল্প, প্রতিদ্বন্দ্বী, শত্রু হিসেবে। চিন্তাপরাধ – থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা তুলে দিচ্ছি –

স্কুলে কিশোর-কিশোরীদের একসাথে সাঁতার শেখার বাধ্যতামূলক ক্লাসে নিজেদের ১২ ও ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তুর্কী বংশোদ্ভূত সুইস নাগরিক বাবা-মাকে প্রায় ষোল শ পাউন্ডের মতো জরিমানা করে বসে সুইটযারল্যান্ডের এক স্কুল। দাবি করে, সাঁতার শেখার ক্লাস স্কুল কারিকুলামের অংশ, তাই সন্তানদের এ ধরনের ক্লাসে না পাঠানোর কোনো এখতিয়ার অভিভাবকদের নেই। জবাবে মামলা করে দেন দুই কিশোরীর বাবা-মা। তাদের যুক্তি হলো, পুরুষের উপস্থিতিতে একই সুইমিং পুলে মেয়েদের সাঁতার শেখা ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী বৈধ না, স্কুল তাদেরকে এ ক্ষেত্রে বাধ্য করতে পারে না। এটা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ। মামলা নাকচ করে দেয় সুইস আদালত।

হাল না ছেড়ে তারা যান ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস (ECHR) এর কাছে। ইউরোপিয়ান কোর্টও রায় দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং সুইস আদালতের পক্ষে। রায়ে বলা হয়, অভিভাবকদের আপত্তি অগ্রহণযোগ্য এবং মুসলিম অভিভাবকরা তাদের কিশোরী মেয়েদের ছেলেদের সাথে একই সাঁতারের ক্লাসে পাঠাতে আইনত বাধ্য। ইউরোপিয়ান আদালতের বিচারকরা স্বীকার করে যে, অভিভাবকদের এভাবে বাধ্য করার কারণে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তবে আদালতের মতে, হস্তক্ষেপ হলেও এতে ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন হচ্ছে না। ঘটনাটা ২০১৭ এর।

ইউরোপের ৭টি দেশসহ পৃথিবীর মোট ১৩টি দেশে নিক্বাব এবং বোরকা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো, বাংলাদেশসহ মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিক্বাব কিংবা বোরকা পরার কারণে নানান সময়ে মুসলিম নারীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে বৈষম্যমূলক আচরণের। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা অথবা বৈষম্যকে বৈধতা দেয়া হয়েছে কোনো না কোনোভাবে সেক্যুলারিযমের দোহাই দিয়ে।

২০১১ তে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে নিক্বাবকে অবৈধ ঘোষণা করে ফ্রান্স। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোযি ঘোষণা করে, পর্দা নারীর দাসত্ব ও শোষণের চিহ্ন এবং সেক্যুলার ফ্রান্সে এর কোনো জায়গা নেই। কোনো মহিলা জনসম্মুখে নিক্বাব পরে বের হলে তাকে ১৫০ ইউরো ফাইন করা হবে। অভিভাবক বা স্বামী যদি কোনো নারীকে নিক্বাব করতে বাধ্য করে, তবে তাকে জরিমানা করা হবে ৩০,০০০ ইউরো।

২০১৭ এর এক রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে তিন তালাক অসাংবিধানিক এবং অনৈসলামিক! ২০১৮ তে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৫ সালে বাবরি মসজিদ-বিষয়ক একটি মামলার রায় বহাল রাখে যেখানে বলা হয়েছে, ‘মসজিদ ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য অংশ নয়। মুসলিমরা যেকোনো জায়গায় নামায পড়তে পারে।’

লক্ষ করুন, প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিমরা কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। তারা কেবল নিজেদের ধর্মের বিধান মানার চেষ্টা করেছে। সেক্যুলার ইউরোপ, ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়া ইউরোপ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, আলাদাভাবে নতুন আইন তৈরি করে কিংবা ফাইন করে মুসলিমদের বাধা দিয়েছে তাদের ধর্ম পালনে। ভারতের ক্ষেত্রে কোনটা ইসলামের অংশ এবং কোনটা না তা নিয়েই ফতোয়াবাজি শুরু করেছে সেক্যুলার সুপ্রিম কোর্ট। এই হলো সেক্যুলারিযমের দেয়া ধর্মীয় স্বাধীনতার বাস্তবতা।

সেক্যুলারিযম এমন ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে যেখানে একসাথে অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে কিশোর-কিশোরীদের সাঁতার শেখা, পরপুরুষ কিংবা পরনারীর হাত ধরা ইসলামী শিক্ষা ও বিধানের লঙ্ঘন কি না সেটা ঠিক করে দেয় সেক্যুলার সংসদ কিংবা আদালত। তিন তালাক কিংবা মসজিদ–ইসলাম ধর্মের অংশ কি না সেটাও সেক্যুলার আদালতই ঠিক করে। যে নারী নিক্বাব করতে চায়, সরকার তাঁকে বাধ্য করে নিক্বাব খুলতে, ‘শোষণের’ হাত থেকে বাঁচানোর জন্য! অর্থাৎ ধর্ম কী বলছে সেক্যুলার রাষ্ট্রে সেটা মূল্যহীন, এমনকি যে বিষয় ধর্মের আওতাভুক্ত বলে সেক্যুলাররিযম স্বীকার করে নেয়, সে ক্ষেত্রেও। ধর্মের কতটুকু পালনযোগ্য আর কতটুকু না, সেক্যুলার সংসদ আর আদালত সেটা ঠিক করবে সেক্যুলার সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের সীমানা ঠিক করে দেবে সরকার।


‘পূজারি ও পূজিত’
চিন্তাপরাধ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *