বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থে আন্দোলন বলতে কী বোঝানো হয়? রাস্তায় অনেক মানুষ নামিয়ে, ভাঙচুর করা, ধাওয়া- পালটাধাওয়া। সহজ ভাষায় দেশ অচল করে দেয়া। পরিস্থিতি এমন অসহনীয় করে তোলা যাতে কোন ‘তৃতীয় শক্তি’ – দেশীয় কিংবা বিদেশী – হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়, এবং এমন একটা সেটেলমেন্টে আসে, যেখানে আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়ার অধিকাংশ মেনে নেয়া হবে।
এই কাজটা যে সবচেয়ে দক্ষভাবে করতে পারে সে আন্দোলনে সবচেয়ে পারদর্শী। এবং এধরনের আন্দোলনে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী হল আওয়ামী লীগ। এটা আমার কথা না, এই দলের নেতাকর্মীরাই এটা গর্বের সাথে বলে।
আমাদের ছোটবেলার লাগাতার হরতাল, অফিসগামী মানুষের কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে হেনস্তা করাসহ সাফল্যের অনেক উদাহরণ আছে। বর্তমানে যে ক্ষমতায় আসা, সেটাও হয়েছিল লগিবৈঠা নিয়ে এমন এক আন্দোলনের পর। এই আন্দোলনে বাংলাদেশের বিভিন্ন বামপন্থী দলও অংশগ্রহণ করেছিল। ঢাকার রাস্তায় বাশ দিয়ে পিটিয়ে মানুষ মারা হয়েছিল। বুকের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে মানুষ খুন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ আর শহুরে মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বের দাবি করা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বিভিন্ন সময় ইনিয়েবিনিয়ে এসব আন্দোলনের বৈধতাও দিয়েছে। আবার কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়কের মতো আন্দোলনগুলো কীভাবে ‘হ্যান্ডেল’ করা হয়েছে, সেটাও বাংলাদেশর সবাই জানে, সবাই বোঝে। এইসব জেনেবুঝেই বাংলাদেশের সুশীল, শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজ, এই সব দল, আর গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। এগুলোর জাস্টিফিকেশন দেয়। অজুহাত বলুন কিংবা জাস্কেটিফিকেশন – কোনটার তখন অভাব হয় না।
কিন্তু বিষয়টা যখন প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের ক্ষেত্রে হয় তখন তাদের পুরো রুলস অফ এনগেইজমেন্ট বদলে যায়। শাপলা চত্বরের ঘটনার পর সব কিছু ছাপিয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, গাছ কাটার বিষয়। আজকে ১৭ জন মুসলিমের মৃত্যুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো শিশুদের আন্দোলনে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সেই আলাপ। মাদ্রাসা শিশুদের নিয়ে এদের কতো চিন্তা! যেমন ইউরোপিয়ান অনেক চিন্তা ছিল নেইটিভদের সভ্য করা নিয়ে।
একই কাজ সেক্যুলার কেউ করলে – বিশেষ করে লীগ কিংবা বামরা করলে, সেটা – আন্দোলন। ইসলামী কোন দল করলে সেটা ‘তান্ডব’। হেলমেট বাহিনীর শুরু করা গ্যাঞ্জামে পাঠাও রাইডারের বাইক পুড়ে গেলে তার লাইফ হিস্ট্রি নিয়ে আবেগে গদগদ প্রতিবেদন তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু হাটহাজারিতে মিছিল করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যাওয়া মুসলিমের ব্যাপারে ‘নিহত’ এর বাইরে আর কোন শব্দ যেন কলম থেকে বের হয় না। নিহত – নামহীন, পরিচয়হীন, পরিবারহীন, চেহারাবিহীন, জীবনের গল্পবিহীন কোন এনটিটি – মানুষ না। শহুরে, সেক্যুলার, সুশীলদের মতো মানুষ না।
শাহবাগের সময় রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে, ট্যাক্সপেয়ারদের অগণিত টাকা নষ্ট হয়েছে – সেগুলোর বৈধতা খুজতে কোন সমস্যা হয়নি। বরং শাহবাগে অন্তত একবার হলে গিয়েও ফটো তুলে, চেক-ইন দিয়ে ফয়েয হাসিল হয়েছে। কিন্তু ইসলামী কোন দলের কর্মসূচীর কারণে যদি নিজের শিডিউলটা চেইঞ্জ হয়, একটু ইনকনভিনিয়েন্স হয়, যদি ডেইটিং এ যেতে, কিংবা ‘স্কোর করতে’ একটু দেরি হয় তাহলে শহুরে মধ্যবিত্তের আর সহ্য হয় না। তখন ‘আই হেইট পলিটিক্স’ মারানো বিদ্বানও ‘আনরেস্ট’, বিশৃঙ্খলা, দেশের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে মহাচিন্তিত দার্শনিক হয়ে ফেইসবুকে জ্ঞান ঝাড়তে চলে আসে।
গত ৮ বছর ধরে বাংলাদেশের সুশীল, সেক্যুলার এবং শহুরে মধ্যবিত্তের এই ভন্ডামি দেখে যাচ্ছি। এর আগেও ব্যাপারটা হয়েছে, দশকের পর দশক ধরে হয়েছে। আমি খেয়াল করিনি। কারণ আমিও তখন তাদের একজন ছিলাম। গত ৮ বছরে দেখেছি এই ভন্ডামির কোন নিয়ম নেই, কোন নীতি নেই। কোন নির্দিষ্ট কাঠামো নেই। যখন যেভাবে ইচ্ছে নিজের সুপ্রিমেসি জাহির করা, এবং আধিপত্য টিকিয়ে রাখা হল এর একমাত্র নীতি।
এরা এমন একটা সমাজ ও সংস্কৃতি তৈরি করেছে যেখানে তাদের ছোট ছোট সমস্যাগুলোও ‘জাতীয় বিপর্যয়’ হিসেবে হাজির হয়, কিন্তু যাদেরকে তারা নিজস্ব বলয়ের বাইরে রেখেছে, যাদেরকে নামপরিচয়চেহারা-বিহীন না-মানুষ বানিয়ে রেখেছে, তাদের জীবন চলে গেলেও কিছু যায় আসে না। এরা সম্পূর্ণ পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট, আবেগ, বিশ্বাসকে খারিজ করে দিয়েছে। জাতীয় জীবন থেকে এই বিষয়গুলোর আলোচনা একরকম মুছে দিয়েছে। সেই সাথে মুসলিম হতে হলে কোন সীমার মধ্যে থাকতে হবে সেটাও র এরা ঠিক করে দিয়েছে। তাই এরা একই সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে, আবার নিজেদের সাচ্চা মুসলিম দাবি করতে পারে। শুধু তাই না, কে ভালো মুসলিম আর কে খারাপ মুসলিম সেটার সনদ দেয়ার ইজারাদারীও তাদের হাতে রেখে দিয়েছে।
মুসলিমদের অনেকে এখনো বিভ্রান্তিবশত কিংবা চিত্তবৈকল্যের কারণে মনে করেন এদের সাথে আলোচনা সম্ভব। এদের সাথে কমন গ্রাউন্ডে আসা সম্ভব। এটা একই সাথে হাস্যকর এবং বিপজ্জনক ডিলিউশান। এই ভাবে নৈতিক এবং আদর্শিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া লোকেদের সাথে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা সম্ভব না। কোন শেয়ারিং অফ আইডিয়াস, কোন সিন্থেসিস সম্ভব না। মানুষ মারা যাবার পর গাছ কাটা আর মোদির আগমণের পর আতিথেয়তার বয়ান আনা প্রতিবন্ধীদের যুক্তির কাউন্টার দেয়ার কোন অর্থ হয় না। আলোচনা করার মতো নুন্যতম লেভেলেই এরা নাই।
তাই এদের যুক্তির খন্ডন কিংবা এদের জবাব পালটা যুক্তি দেয়ার কোন অর্থ হয় না। বরং এদের থরোলি রিডিকিউল এবং ডিলেজেটেমাইয করা দরকার, যেভাবে এরা মুসলিমদের ডিলেজেটেমাইয করেছে। .আপনার জমির ওপর এরা যে ঘর বানিয়েছে, সেই ঘরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই। এই ঘরে ভাড়া থাকার পথ খোজার কোন অর্থ হয় না। হেজেমনি আর কালচার ওয়ার একটা যিরো-সাম গেইম, সমবায় সমিতি না।