তারিক রমাদানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও চিন্তার বদলে ব্যক্তিতে মনোনিবেশ


তারিক রমাদান ও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। অভিযোগের ধরন এবং তার পক্ষ থেকে আসা আংশিক স্বীকারোক্তির কারনে হয়তো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা একটু বেশিই হচ্ছে। মোটা দাগে এ ব্যাপার দু’ধরনের আলোচনা দেখেছি। একটি হল ফ্রেঞ্চ তথা পশ্চিমা বিচার বিভাগের দ্বিমুখীতা। অপরাধ প্রমানের আগেই, কোন নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না গিয়েই আজ প্রায় ৮ মাস তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। সলিটারি কনফাইনমেন্ট করা হয়েছে। মিডিয়াতে ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেইশান করা হচ্ছে। পশ্চিমা সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতা, বিচার ব্যবস্থা ও সুবিচারের জায়গা থেকে এখানে কুফফারের দিক থেকে পরিষ্কার একটি ডাবলস্ট্যান্ডার্ড কাজ করছে। প্রথম আলোচনার ফোকাস হল এ নিয়ে প্রতিবাদ আর পিটিশনের।

দ্বিতীয় আলোচনাটি হল ব্যক্তি তারিক রমাদান এবং ইসলামী নৈতিকতার দিক থেকে তার পদস্খলন নিয়ে।

মুসলিমদের মধ্যে যারা তার সমর্থক ও অনুসারী এবং সেন্সিবল কিছু কাফির প্রথম পয়েন্টে ফোকাস করছে। মুসলিমদের মধ্যে যারা তার চিন্তা ও মতাদর্শের বিরোধী তাঁদের অনেকেই ফোকাস করছেন দ্বিতীয় পয়েন্টে। আমি নিজে তারিক রমাদান ও তার ঘরানার চিন্তা ও চিন্তাবিদদের ঘোরতর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এ দুই আলোচনার কোনটাই আমার কাছে তেমন দরকারী অথবা ইফেক্টিভ মনে হচ্ছে না।

প্রথম আলোচনা কেন অর্থহীন সেটা ব্যাখ্যা করার তেমন দরকার আছে বলে মনে হয় না। যে সভ্যতা ভাবলেশহীনভাবে ঠুনকো অজুহাতে কোটি-কোটি মুসলিম হত্যা করতে পারে, তাদের দালাল শাসকদের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আলিম ও দা’ঈদের বন্দী করে রাখতে পারে, যে সভ্যতা আল-আকসা দখলের সক্রিয় অংশীদার, যে সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে কলোনিয়াল আর নিও-কলোনিয়াল লুটপাটের ওপর – তাদের কাছে প্রতিবাদ আর পিটিশনের আলোচনায় কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে বলে বিভ্রান্ত কিংবা মূর্খ ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। প্রতিবাদ আর পিটিশনের ভাষা তারা বোঝে না, এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বলতে চাইলে তাদের সাথে ঐ ভাষায় কথা বলতে হবে, নেগোশিয়েইট করতে হবে – যেটা তাঁরা বোঝে।

দ্বিতীয় আলোচনাটি কেন অতোটা ইফেক্টিভ না, সেটা বলি।

প্রথমত, ব্যক্তি তারিক রমাদানকে নিয়ে আলোচনায় আমি লাভ দেখি না, কারণ আমার সমস্যা পারসোনালি তাকে নিয়ে না। তিনি যদি কোন দোষ না-ও করতেন, একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের যাহিদ ব্যক্তিও হতেন, তাও আমি তার বিরোধিতা (তার চিন্তার বিরোধিতা) করতাম। তার ব্যক্তিগত আমলদারিতা কিংবা গুনাহ কোনটাতেই আমার মত বদলাবে না। আমার সমস্যা তিনি যা প্রচার করেন সেটা নিয়ে। তারিক রমাদান, একজন রিভিশনিস্ট, মডারেট মুসলিম। তার চিন্তাভাবনার ব্যাপারে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণার জন্য নিচের লিঙ্কটি দেখা যেতে পারে – https://bit.ly/2N2m1L9। ইন ফ্যাক্ট রিদ্দার হদ, রজম, ফ্রি-মিক্সিং কিংবা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের রমাদান কিংবা কারদ্বাউয়ির মতো লোকদের মতের চেয়েও বেশি গুরুতর ব্যাপার হল তাদের সামগ্রিক দর্শন। যা হল আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার ছাঁচে ফেলে ইসলাম ও শরীয়াহর ব্যাপারে মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি ‘সংস্কার’ (পড়ুন – বদলে ফেলা) করা।

কবিরাহ গুনাহ কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে ফাসেকির চেয়ে এ বিষয়টি অনেক গুরুতর। কাজেই আমাদের বিরোধিতার কারণ ও ফোকাস হওয়া উচিত এসব বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর অবস্থান থেকে তার বিচ্যুতি এবং উম্মাহর জন্য এধরনের দাওয়াহর ক্ষতি। এ মূহুর্তে তার ব্যক্তিগত পদস্খলন নিয়ে আলোচনা করে হয়তো তার অনুসারী ও ভক্তদের এক হাত নেয়া যেতে পারে, কিন্তু এর বাইরে তেমন কোন লাভ আমি দেখি না। আর এটা যুদ্ধের অনারেবল পদ্ধতিও না, সে যুদ্ধ আদর্শিক হোক বা সামরিক। বরং অন্যভাবে এ ঘটনাকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়।

একটা ব্যাপার চিন্তা করুন। রমাদান জীবনভর আধুনিক পশ্চিমা সমাজ, মূল্যবোধ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ইত্যাদির অনেক দিকের প্রশংসা করেছেন। পশ্চিমা সেন্সিবিলিটির সাথে খাপ খায়না ইসলামী শরীয়াহর এমন অনেক বিষয়ের ব্যাপারে তিনি এমন সব ব্যাখ্যা এনেছেন যেগুলো কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না। পশ্চিমের কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলাম ও ডিসকোর্স তুলে ধরার প্রায় সব চেষ্টাই তিনি করেছেন। কিন্তু যখন সুযোগ পেয়েছে তখন এই ব্যবস্থাই নিজেদের বানানো সব নিয়ম একপাশে ছুড়ে ফেলে তাকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। যে সমাজকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে তিনি মুসলিম বিশ্বের ‘সংস্কার’ চেয়েছেন, সেই সমাজ আজ সুযোগ পেয়ে তাকে মাটিতে ফেলে লাথি দিচ্ছে। তারিক রমাদানের সাথে ফ্রেঞ্চ তথা বিচার ব্যবস্থা ও সমাজ যে যুলুম করছে তা থেকেই রমাদানের প্রচারিত আদর্শের খন্ডন হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তো আমাদের বলেই দিয়েছেন –

আর ইয়াহূদী ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর। [আল-বাক্বারা, ১২০]

তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা অধিক ভয়াবহ। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে। [আলে ইমরান, ১১৮]

‘পশ্চাৎপদ”, “উগ্র” ও “ডগম্যাটিক” মুসলিমদের সামনে যে সভ্যতাকে উদাহরন হিসেবে পেশ করে তারিক রমাদান সংস্কারের কথা বলতেন, সেই সভ্যতাই আজ তার ব্যাপারে নিকৃষ্ট ধরনের ডাবলস্ট্যান্ডার্ড আর হিপোক্রিসির প্রমাণ দিচ্ছে। এবং এটা সে কথাই আবারো প্রমাণ করে যা ইমাম আহমাদ শাকির রাহিমাহুল্লাহ অনেক আগেই বলেছিলেন –

ইউরোপিয়ানদের স্বাধীনতা আর সভ্যতার বুলি শুনে বিভ্রান্ত আর প্রতারিত হয়ো না। কারণ তাদের ‘স্বাধীনতা’ হল ইউরোপিয়ানদের স্বাধীনতা এবং আমেরিকা ও অন্যান্য জায়গায় থাকা ইউরোপিয়ানদের স্বাধীনতা। (কালিমাতুল হাক্ব, পৃষ্ঠা ৯৭)

ব্যক্তি তারিক রমাদানকে নিয়ে আলোচনার চেয়ে এ আলোচনা আরো অনেক বেশি কার্যকরী। আপন যতোই মডারেট হন, শান্তিবাদী-গান্ধিবাদী হন, আপনি যতোই সহাবস্থানের কথা বলেন, আপনি যতোই তাদের ভাষায় কথা বলেন, তাদের মতো করে ডিসকোর্স করেন, তাদের টার্মিনোলজি অথবা আদর্শ মুখস্থ করে বমি করে দেন না কেন, লাভ নেই। শেষ পর্যন্ত ওদের মন পাবেন না। যতোক্ষন আপনি মুসলিম আছেন – নমিনালি হলেও – আজ হোক কাল হোক, ওরা আপনার পেছনে লাগবেই।

দ্বিতীয়ত, দিনশেষে আমাদের একটা প্রশ্ন নিয়ে একটু চিন্তা করা উচিৎ। পশ্চিমের ব্যাপারে এতো ছাড় দেয়ার পরও পশ্চিমা কুফফার কেন তার সাথে আজ এরকম করছে? তারা যালিম, দ্বিমুখী, সেটা মুসলিম হিসেবে আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু তাদের দিক থেকে এরকম আচরণের জাস্টিফিকেশন কী? যিনা তো তাদের কাছে কোন অপরাধ না। নায়ক, প্রযোজক, কমেডিয়ান, পাদ্রী, কার্ডিনাল – ধর্ষনের অভিযোগ তো কতো মানুষের বিরুদ্ধে ওঠে। কই আর কারও সাথে তো এমন করা হল না, তারিক রমাদানের সাথেই এমন কেন? কারণ হল, সবকিছুর পরও তারিক রমাদান একটা ইসলামিক রিভাইভাল চায়। এক অর্থে তিনি একজন প্যান-ইসলামিস্ট। তার ইসলামের কারনেই কুফফার তার সাথে এ আচরণ করছে। আর কোন কিছুর কারণে না।

কাজেই এ জায়গায় কুফফারের বিরুদ্ধে আমি তার পক্ষে। এবং এ পরিস্থিতিতে তার ব্যক্তিগত স্খলন নিয়ে আলোচনা ইফেক্টিভ তো না-ই , এমনিতেও সমীচিন মনে হয় না। আমি বলছি না যে তার ভুলের ব্যাপার চেপে যেতে হবে, তার বিপক্ষে বলা যাবে না বা আজ হঠাৎ তার পক্ষে সাফাই দিতে হবে। বরং আমি বলছি, ১) আমাদের বিরোধিতা হওয়া উচিৎ মতাদর্শের বিরুদ্ধে, ব্যক্তির বিরুদ্ধে না, ২) যদিও আমি তার আদর্শ ঘৃণা করি কিন্তু কুফফারের বিরুদ্ধে আমি তার পক্ষে যতোক্ষন তিনি একজন মুসলিম।

শাইখরা একটা কথা বলেন যার মাধ্যমে খুব সুন্দরভাবে এই পয়েন্টটা সাম-আপ করা যায়। কথাটা অনেকটা এরকম – তারা আমাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্ধারিত সীমার পরোয়া না করলেও আমরা তাদের ব্যাপারে আল্লাহর সীমাগুলো মেনে চলবো এবং আল্লাহ্‌র নির্ধারিত দায়িত্বগুলো পালন করবো।

তোমরা আমাদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করলেও আমরা তোমাদের ব্যাপারে শরীয়াহর আলোকে যথাসম্ভব উত্তমটাই করার চেষ্টা করবো।

একথা মডারেটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা আমাদের তাকফির করে, তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটাই আল ওয়ালা ওয়াল বারা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *