[লেখাটি নেয়া হয়েছে এলজিবিটি আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিতব্য (ইন শা আল্লাহ) বই ‘অবক্ষয়কাল’ থেকে]
ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ এতো প্রভাবশালী হয়ে উঠলো কী করে?
ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ কীভাবে তৈরি হলো, কীভাবে আজকের পৃথিবীতে এতো শক্তিশালী অবস্থান পৌঁছলো–সে আলোচনা অনেক লম্বা। এর সাথে জড়িত আছে পাশ্চাত্যের দর্শন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তি পরিচয় ও মানবাধিকারের ধারণাসহ আরো অনেক কিছু। তবে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের উত্থানের পেছনে সরাসরি সম্পর্ক খুঁজতে গেলে নিচের তালিকা পাওয়া যাবে-
- পাশ্চাত্যের নারীবাদী আন্দোলন, বিশেষ করে নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় ধারা (Third wave feminism), যা নারীত্ব ও পুরুষের ধারণাকে আক্রমণ করেছে।
- অ্যামেরিকাতে হওয়া ‘সমকামী অধিকার আন্দোলন’, যার মাধ্যমে সমকামিতাসহ নানা বিকৃত যৌনতা এবং ‘সমকামী বিয়ে’ আইনী বৈধতা পেয়েছে।
- ষাটের দশকে অ্যামেরিকায় ঘটা ‘যৌন বিপ্লব’, যা যৌনতার ব্যাপারে সব ধরনের মূল্যবোধ মুছে ফেলেছে।
- এ তিনের মিশ্রণে তৈরি হওয়া জেন্ডার আইডেন্টিটি (Gender Identity) মতবাদ।
- চিকিৎসাশাস্ত্র, চিকিৎসক ও ফার্মাসিউটিকাল ইন্ডাস্ট্রির একটি অংশ।
- সমকামিতা ও অন্যান্য বিকৃতির স্বাভাবিকীকরণে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা দাতারা।
এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়-
ষাটের দশক থেকে শুরু করে প্রায় ৫ দশক ধরে অ্যামেরিকাতে চলে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার আন্দোলন। মিডিয়া, অ্যাক্টিভিজম, আইন-আদালতসহ নানাভাবে এ আন্দোলন চেষ্টা চালিয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের। বিকৃত যৌনাচারে আসক্ত লোকদের উপস্থিত করা হয় ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ আর ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে। বিকৃত যৌনতার বৈধতার দাবি তোলা হয় মানবাধিকারের নামে।
পঞ্চাশ বছর ধরে গড়ে ওঠে দাতা, এনজিও, অ্যাক্টিভিস্ট, মিডিয়া, উকিল, রাজনীতিবিদ আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। শেষমেষ ২০১৫ সাল নাগাদ সমকামিতা এবং ‘সমকামী বিয়ে’ পশ্চিমা বিশ্বে বৈধতা পেয়ে যায়। আর তার ঠিক পরপর, পাঁচ দশক ধরে গড়ে ওঠা এই নেটওয়ার্ক মনোযোগ দেয় ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রচার ও প্রসারে।
এ নেটওয়ার্কের একদম উপরে আছে বিশাল সব দাতা। যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এইসব বিকৃতির প্রসারে খরচ করে চলছে। তাদের টাকাগুলো দিয়ে গড়ে উঠছে নানান এনজিও। এনজিওগুলো রাজনীতিবিদদের কাছে দেনদরবার করছে, নানা ইস্যুতে মামলা ঠুকে দিচ্ছে, তৈরি করছে অসংখ্য অ্যাক্টিভিস্ট যারা ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন ও অফলাইন প্রচারণায়। একইসাথে এই দাতারা বড় বড় রাজনীতিবিদের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের পেছনেও টাকা ঢালছে, সেই সাথে শর্ত জুড়ে দিচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে সমকামিতা আর ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে এনজিওগুলো আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, তারা উকিলদের দিয়ে খসড়া আইন বানাচ্ছে, তারপর নিজেদের নেটওয়ার্কের প্রভাব খাটিয়ে সেগুলো পাশ করিয়ে আনছে বিধানসভা থেকে। এভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে বিকৃত যৌনতা বৈধ হয়ে যাচ্ছে।
নিজ দেশে বৈধতা দেওয়ার পর শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ব্যবহার করে সারা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের নামে বিকৃত যৌনতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ঐ যে বড় বড় দাতাদের কথা বললাম, তাদের টাকায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও। এসব এনজিওগুলোর অনেকে ‘মানবাধিকার’ আর সামাজিক ইস্যুতে খোদ জাতিসংঘের উপদেষ্টা বনে বসে আছে। এইসব এনজিও এবং শক্তিশালী পশ্চিমা বিশ্বগুলোর ক্রমাগত সুপারিশের ফলে একসময় জাতিসংঘও বিকৃত যৌন আচরণকে মানবাধিকার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
যার ফলে অ্যামেরিকান সরকার থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা আজ বিশ্বব্যাপী ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ এবং সমকামিতার স্বাভাবিকীকরণে কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ২০২১ এর জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষর করে। এতে বলা হয়, ভিন দেশে কাজ করা মার্কিন সংস্থাগুলো যেন এলজিবিটিকিউআই (সমকামিতা, ট্র্যান্সজেন্ডার ও অন্যান্য বিকৃত যৌনতার স্বাভাবিকীকরণের আন্দোলন) ইস্যুতে বিদেশী সরকারগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য সব ধরনের কূটনৈতিক এবং সহায়তামূলক উপকরণগুলো কাজে লাগানোর কথা বিবেচনা করে। পাশাপাশি যথাযথ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ভিসা রেস্ট্রিকশান এবং অন্যান্য অ্যাকশনও বিবেচনা করে।[1]
অর্থাৎ কোন দেশ যদি সমকামিতা এবং ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে মার্কিন সরকার তাদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারে, তাদেরকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। তাদের উপর আরোপ করতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা রেস্ট্রিকশান। সম্প্রতি সমকামিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় উগান্ডার বিরুদ্ধে স্যাংশান দেওয়া হয়েছে।[2]
বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এসব তো পশ্চিমা বিশ্বের সমস্যা। আমাদের এ নিয়ে এতো মাথাব্যথার কী আছে?
উত্তর হলো, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে গেছে বহুদূর। অল্প কিছু খবর দেখে নেওয়া যাক। ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারদের সুরক্ষায় আইন হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে –
বৈষম্য ও লাঞ্ছনার শিকার ট্র্যান্সজেন্ডারদের সুরক্ষা ও অধিকার এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘ট্র্যান্সজেন্ডার অধিকার সুরক্ষা আইন’ নামের আইনটি পাস হলে বৈষম্য থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলবে ট্র্যান্সজেন্ডারদের। বৃহস্পতিবার এমন তথ্য জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক রবিউল ইসলাম।
উপপরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ট্র্যান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতের জন্য ট্র্যান্সজেন্ডার অধিকার সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য এই জনগোষ্ঠী ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগামী মাসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে সবার মতামত নিয়ে একটি আইন তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর এটি সংসদে উপস্থাপন হবে। তারপর বাস্তবায়ন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আইনটি বাস্তবায়িত হলে এই কমিউনিটির মানুষগুলো আর সেবা নিতে বৈষম্যের শিকার হবে না। বিদেশ যেতে পাসপোর্ট নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জটিলতার নিরসন হবে। আইন দ্বারা তাদের অধিকার নিশ্চিত হবে।’
এখান থেকে বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠার ধাপগুলো স্পষ্টভাবে জানা যায়।
- প্রথম ধাপে, ‘ট্র্যান্সজেন্ডার অধিকার সুরক্ষা’র জন্য আইনের খসড়া তৈরি হবে।
- দ্বিতীয় ধাপে, খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
- তৃতীয় ধাপে, আইন মন্ত্রণালয় আইন চূড়ান্ত করবে।
- চতুর্থ ধাপে, আইন সংসদে উত্থাপন করা হবে এবং সেখানে তা পাশ হয়ে যাবে।
এই চার ধাপের মধ্যে আমরা এখন ঠিক কোন ধাপে আছি?
দ্বিতীয় ধাপ শেষ, আমরা এখন আছি তৃতীয় ধাপে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘ট্র্যান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় আইন দ্রুত পাশ হবে’ শিরোনামের এক খবরে বলা হচ্ছে-
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আমরা ট্র্যান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষায় আইনের খসড়া প্রণয়ন করতে পেরে খুশি। এই কমিউনিটির সদস্যদের সমাজের মূলস্রোতধারায় আনাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সমাজসেবা অধিদপ্তরের আয়োজনে ‘ট্র্যান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন’ এর খসড়ার কমিউনিটি কনসালটেশন কর্মশালায় এ কথা বলেন তিনি। এ কর্মশালা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল, শাহবাগে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির প্রিন্সিপাল সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ফানসেসকো টোরনেইরি এবং এডিবির জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন স্পেশালিস্ট নাশিবা সেলিম।
অর্থাৎ, ২০২২ সালে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৩ নাগাদ খসড়া তৈরি হয়ে গেছে। ধারণা করা যায়, ২০২৪ বা বড়জোর ২০২৫ এর মধ্যে এই আইন সংসদে পাশ হয়ে যাবার জোরালো সম্ভাবনা আছে। সে সময়ে বাংলাদেশে যে সরকারই থাকুক, সরাসরি অ্যামেরিকার বিরোধিতা করে এ আইনের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নেবে, এ সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। বিশেষ করে আগের ধাপগুলোর কাজ যখন এতো দ্রুত এগিয়ে গেছে।
পাঠ্যপুস্তক: এ তো গেল আইনের কথা। সামাজিকভাবে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদকে বৈধতা দেওয়ার নানা প্রক্রিয়া চলছে। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ ও বিকৃত যৌনতার স্বাভাবিকীকরণ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড NCTB সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ে ৫১-৫৬ পৃষ্ঠায় ‘শরীফার গল্প’ শিরোনামের লেখায় সরাসরি ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের দীক্ষা দেওয়া হয়েছে।
৫১ পৃষ্ঠায় মূল চরিত্র শরীফা বলছে,
“আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে…
এ গল্পে শরীফা নিজেই স্বীকার করছে, সে ছোটবেলায় ছেলে ছিল। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হলো তখন সেই শরীফ আহমেদই নিজেকে মেয়ে ভাবতে শুরু করলো এবং মেয়েদের মতো আচরণ করতে লাগলো। আর এটাই তার ভালো লাগে।
৫২ পৃষ্ঠায় মূল চরিত্র শরীফাকে একজন বলছে,
“…আমরা নারী বা পুরুষ নই। আমরা হলাম ট্র্যান্সজেন্ডার।”
একই বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় নতুন প্রশ্ন অনুচ্ছেদে পাঁচজন শিক্ষার্থীর কথোপকথনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই কথোপকথনে এক শিক্ষার্থী বলছে তার মা তাকে শিখিয়েছে,
‘…ছোটদের কোনো ছেলে-মেয়ে হয় না। বড় হতে হতে তারা ছেলে বা মেয়ে হয়ে ওঠে।’
আপাতভাবে নির্দোষ শোনালেও ঠিক আগের পৃষ্ঠায় ট্র্যান্সজেন্ডার সংক্রান্ত আলোচনার আলোকে দেখা হলে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, নারীপুরুষের আলাদা লিঙ্গ পরিচয়ের ধারণাকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে সপ্তম শ্রেণীর বইটির এই অধ্যায়ে।
৫৫ এবং ৫৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,
‘আমরা যে মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখেই কাউকে ছেলে বা মেয়ে বলছি, সেটা হয়তো সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়।’
‘…এখন বুঝতে পারছি, ছেলে-মেয়েদের চেহারা, আচরণ, কাজ বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কোনো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নেই।’
‘…একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন তার শরীর দেখে আমরা ঠিক করি সে নারী নাকি পুরুষ। এটি হলো তার জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়। জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে একজন মানুষের কাছে সমাজ যে আচরণ প্রত্যাশা করে তাকে আমরা ‘জেন্ডার’ বা ‘সামাজিক লিঙ্গ’ বলি। জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে তার জেন্ডার ভূমিকা না মিললে প্রথাগত ধারণায় বিশ্বাসী মানুষেরা তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।’
অর্থাৎ, একজন মানুষ পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সে যদি কোনো এক বয়সে নিজেকে নারী দাবী করে তাহলে সে নারী। আবার নারী দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা কেউ যদি নিজেকে পুরুষ দাবী করে তাহলে সে পুরুষ। যতোক্ষণ না অন্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে ততোক্ষণ যা খুশি তা-ই করা যায়। যারা এটা মেনে নেবে না তারা সেকেলে, পশ্চাৎপদ।
কথাগুলো সরাসরি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আমদানী করা। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ এবং জেন্ডার আইডেন্টিটি মতবাদের যে বিষয়গুলো পশ্চিমা স্কুলগুলোতে শেখানো হচ্ছে, সেগুলো এখন শেখানো হচ্ছে আমাদের সন্তানদেরও। আত্মপরিচয় এবং যৌনতা নিয়ে বিকৃতিকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করে নিতে শেখানো হচ্ছে আমাদের শিশুদের।
শিশুকিশোররা সহজে প্রভাবিত হয়, নতুন জিনিসের প্রতি তাদের থাকে সহজাত আগ্রহ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোমলমতি কিশোরদের সামনে বিকৃতি ও অসুস্থতাকে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বয়ঃসন্ধিকালে এমনিতেই নানা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। তার উপর লিঙ্গ নিয়ে এমন বিভ্রান্ত ধারণায় মগজধোলাই কিশোর কিশোরীদের জীবন বিষিয়ে দেবে। জন্ম নেবে নানা ধরনের অসুখ ও অসঙ্গতি।
মিডিয়া: বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে পুরোদমে কাজ করছে মিডিয়া। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে ইতিবাচকভাবে নানা ধরনের প্রতিবেদন নিয়মিত আসছে নিউজ মিডিয়াতে। গুগল এবং ইউটিউবে ট্র্যান্সজেন্ডার লিখে সার্চ দিয়ে যে কেউ এ কথা যাচাই করে দেখতে পারেন। নিউজ মিডিয়ার পাশাপাশি বিনোদন জগতের মাধ্যমেও ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতাতেও নারী সাজা পুরুষদের স্থান দেওয়া হচ্ছে।[3] বলা বাহুল্য, এগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজে আলোড়ন তৈরি করা।
এনজিও ও অ্যাক্টিভিস্ট: ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বিভিন্ন এনজিও ও অ্যাক্টিভিস্টরা। কিছুক্ষণ আগে আমরা যেই আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের কথা বললাম, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিওর অর্থায়নে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে দেশীয় এনজিওগুলো। একটা ছোট্ট উদাহরণ থেকে পুরো নেটওয়ার্কটা কীভাবে কাজ করে তা দেখে নেওয়া যাক।
সমকামিতা ও ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ আন্দোলনের পেছনে সবচেয়ে বড় দাতাদের তালিকা করলে প্রথম তিনের মধ্যে নির্ঘাত একটা নাম পাবেন, আরকাস ফাউন্ডেশন (Arcus Foundation)। এই ফাউন্ডেশন তৈরি করেছে অ্যামেরিকান বিলিয়নেয়ার জন স্ট্রাইকার। স্ট্রাইকার নিজে একজন সমকামী।
২০০৭ থেকে ২০১০ এর মধ্যে বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া আরকাস ফাউন্ডেশনের অনুদানের পরিমাণ ৫৮.৪ মিলিয়ন ডলার। পরের ১২ বছরে সংখ্যাটা বেড়েছে আরো বহুগুণ।[4] স্ট্রাইকারের সাথে অনেক দিন ধরে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে আরেক সমকামী ধনকুবের টিম গিল। গিল, স্ট্রাইকার এবং তাদের ক্ষমতাবান বন্ধুরা মিলে এলজিটিবিকিউ এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থাকে সব মিলিয়ে মোট ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অনুদান দিয়েছে।[5] এই বিপুল পরিমাণ অনুদানের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক।
আরকাস ফাউন্ডেশনের সাথে জড়িত বা তাদের কাছ থেকে অনুদান পাওয়া সংস্থার মধ্যে প্রথমেই আসবে ইলগা (ILGA)-এর নাম।[6] ১৬০টিরও বেশি দেশ মিলিয়ে মোট ১৭০০টিরও বেশি সংস্থার সাথে কাজ করা এই এনজিও জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উপদেষ্টার পদমর্যাদা উপভোগ করে।[7]
আবার বাংলাদেশে যারা সমকামিতা ও ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসার কাজ করছে তাদেরকে নানাভাবে সহায়তা করছে এই আন্তর্জাতিক এনজিও। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে আছে বাংলাদেশীদেরও আনাগোনা।[8]
অর্থাৎ নানান হাত ঘুরে স্ট্রাইকারদের দেওয়া অনুদানের ডলার আমাদের এ মাটিতেও সমকামিতা, ট্র্যান্সজেন্ডারবাদসহ নানা বিকৃতির প্রচার ও প্রসারে দেদারসে খরচ হচ্ছে। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে কাজ করা দেশীয় এনজিওগুলোর সাইটে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের সাথে সম্পর্কের কথা খোলাখুলি বলা আছে, যে কেউ যাচাই করে নিতে পারেন।
ইলগার মতো আরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও বাংলাদশে সমকামীতা, ট্রান্সজেন্ডারবাদসহ বিভিন্ন বিকৃতির স্বাভাবিকীকরণে সহায়তা করছে, তা ধরে নেয়া অমূলক হবে না।
গুগল, ফেইসবুক এবং টুইটারে ‘transgender rights Bangladesh’ দিয়ে সার্চ করলে UNDP, UNFPA এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশী কিছু প্রতিষ্ঠানের নামও পাওয়া যায়, যেমন বন্ধু ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, সম্পর্কের নয়া সেতু, ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ, নো পাসপোর্ট ভয়েস, ট্র্যানসেন্ড, পথচলা বাংলাদেশ ইত্যাদি।[9] দৈনিক সমকালের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশব্যাপী ট্রান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে কাজ করছে ‘৩০টি কমিউনিটি বেসড অর্গানাইজেশন’।[10]
উল্লেখ্য, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনগুলি সরাসরি এলজিবিটি অর্থাৎ সমকামীতা ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে কাজ করছে, আর কোনগুলি হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্য গড়ে উঠেছিল, তা পরিষ্কার না।
ট্র্যান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্টরা পৌছে গেছে প্রধানমন্ত্রীর অফিসেও। ১০ই অগাস্ট, ২০২৩-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে,
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ট্র্যান্সজেন্ডার হো চি মিনের সাক্ষাৎ
ট্র্যান্সজেন্ডার মানুষদের জন্য আজকের দিনটি মাইলফলক বলে মন্তব্য করেছেন ট্র্যান্সজেন্ডার হো চি মিন ইসলাম। বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর হো চি মিন ইসলাম এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এ কথা বলেন।
খুব শীঘ্রই ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ সংসদেও পৌছে যাবে, আর তারপর রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবাদে ঢুকে পড়বে ঘরে ঘরে, এমন আশঙ্কা এখন আর অমূলক মনে হবার কথা না।
[1] https://www.whitehouse.gov/briefing-room/presidential-actions/2021/02/04/memorandum-advancing-the-human-rights-of-lesbian-gay-bisexual-transgender-queer-and-intersex-persons-around-the-world/
[2] US imposes visa restrictions on Uganda officials after anti-LGBTQ law, Reuters, June 17, 2023.
World Bank halts new Uganda loans over anti-LGBTQ+ law, BBC, August 9, 2023.
[3] সুন্দরী প্রতিযোগিতায় ট্রান্সজেন্ডার নারী রাদিয়া | DBC NEWS
সুন্দরি প্রতিযোগিতায় লড়বেন আরও এক ট্রান্সজেন্ডার | সময় টিভি
[4] https://www.arcusfoundation.org/grantees-center-lgbtq-people-pushed-to-the-margins-to-lead-policy-and-culture-change/
[5] https://www.rollingstone.com/politics/politics-features/meet-the-megadonor-behind-the-lgbtq-rights-movement-193996/
[6] https://www.arcusfoundation.org/advancing-lgbtq-equality-and-social-justice-globally/
[7] https://en.wikipedia.org/wiki/International_Lesbian,_Gay,_Bisexual,_Trans_and_Intersex_Association
[8] যুক্তরাষ্ট্রের ইলগা ওয়ার্ল্ডের বোর্ড সদস্য হলেন বাংলাদেশি তাসনুভা আনান, দৈনিক যুগান্তর, ১৪ জুন ২০২২
https://www.jugantor.com/exile/562342/যুক্তরাষ্ট্রের-ইলগা-ওয়ার্ল্ডের-বোর্ড-সদস্য-হলেন-বাংলাদেশি-তাসনুভা-আনান
[9] খসড়াতেই আটকে আছে ট্রান্সজেন্ডার আইন, ঢাকা ট্রিবিউন, ৩১ মার্চ ২০২৩,
https://www.banglatribune.com/others/792239/খসড়া-তৈরিতেই-আটকে-ট্রান্সজেন্ডার-আইন
TransEnd: empowering the transgender community, New Age, May 30,2021,
[10] ‘ট্রান্সজেন্ডার-তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় আলাদা আইন দরকার’, দৈনিক সমকাল, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩