অনেক সময় ঘটনার চেয়ে ঘটনাপরবর্তী প্রতিক্রিয়া থেকে আরো বেশি ইনসাইট পাওয়া যায়। দিন দুয়েক ধরে টিএসসির মোড়ের ভাইরাল হওয়া ছবির প্রতিক্রিয়া দেখছিলাম। বরাবরের মতোই দুটো দল। একদল “প্রেম প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে” আরেক দল “রাস্তাঘাটে অসভ্যতার” বিরুদ্ধে। প্রথম দল নিয়ে আপাতত কিছু বলার নেই। তাদের চিন্তার জায়গা থেকে তাদের কন্সিস্টেন্সি আছে। দ্বিতীয় দলের প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকানো যাক।
গৎ বাঁধা হাহুতাশ, গালি, তির্যক মন্তব্য এবং হাসিঠাট্টার স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এ দলের একজন ছবির মেয়েটির কথা বলেছেন। অনুরোধ করেছেন এমন একটি ছবি ভাইরাল হবার পর বাসায় তার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে – সেটা ভেবে দেখার। বলেছেন, শুধু এ ব্যাপারটি চিন্তা করে হলেও দেশের বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় এমন একটি ছবি প্রকাশ করা উচিৎ হয়নি।
এই এক কথার মধ্যে আমাদের সমাজের “রক্ষণশীল সমাজ”-এর রক্ষণশীলতার ইনহেরেন্ট দুর্বলতাগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের রক্ষণশীলদের কাছে ভালো ও খারাপের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা। কিংবা বলা যায়, এটাই তাদের কাছে ভালোমন্দের মাপকাঠি। প্রকাশ্যে টিএসসি-তে ভিজতে ভিজতে করা কাজটি বন্ধ রুমের ভেতরে করলে এ রক্ষণশীল সমাজের অনেকেই সেটাকে ‘গুনাহ’ মনে করে না। সমাজের আপত্তি “পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশান” নিয়ে। কারণে সমাজ এখনো এই পাবলিক ডিসপ্লে হজম করতে প্রস্তুত না। কাজটা খারাপ হয়েছে কারণে আমাদের সমাজ বাস্তবতায় এটা রোম্যান্টিক না, অসভ্যতা।
যখন ব্যাপারটা আপনি এভাবে ফ্রেইম করবেন তখন সেটা আর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে জড়িত থাকে না। তখন সেটা পরিমিতিবোধের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এবং টিএসসিতে এরকম পঞ্চাশটা কাপল বসে একই কাজ করার চেয়েও এই মেন্টালিটি আরো বেশি বিপদজনক। মূলধারার রক্ষণশীলতা মাপকাঠি হিসেবে নিচ্ছে সামাজিক গ্রহনযোগ্যতাকে। ভালোমন্দ, ঠিক-বেঠিক নির্ধারিত হচ্ছে সমাজ কতটুকু মেনে নিতে রাজি, সমাজ কতোটুকু মেনে নিতে অভ্যস্ত – তার ওপর ভিত্তি করে। আপনি ‘সমাজের অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি’ নামক ক্রমপরির্তনশীল একটা বিষয়কে নৈতিকতার মানদন্ড বানাচ্ছেন। এর ফলাফল হল, যখন সমাজ এ ছবি মেনে নেবে (এবং এভাবে চললে সেদিন খুব দূরে না) তখন এ ব্র্যান্ডের রক্ষণশীলদের বিরোধিতার আর কোন জায়গা থাকবে না।
ইউটিউবে ট্রাম্প সাপোর্টারদের বানানো হিলারি-বিরোধী অনেক ভিডিও পাবেন। এরকম একটা ভিডিওতে দেখানো সময়ের সাথে সমকামী-বিয়ের ব্যাপারে হিলারির অবস্থান কিভাবে বদলেছে। ২০০৪ তে হিলারি বলেছিল, ‘আমি বিশ্বাস করি বিয়ে হল নারী ও পুরুষের মধ্যে পবিত্র বন্ধন’। ৬ বছর পর, ২০১০ তে, ‘আমি সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়েকে সমর্থন করিনি, তবে (তাদের মধ্যে) সিভিল পার্টনারশিপ ও কন্ট্র্যাকচুয়াল রিলেশানশিপ সমর্থন করি।’ ২০১৩ তে বলেছে, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং পলিসি হিসেবে গেই এবং লেসবিয়ানদের বিয়ে সমর্থন করি”। আর ২০১৫তে যখন অ্যামেরিকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে সমকামী বিয়েকে আইনী বৈধতা দেয়া হয়, তখন হিলারি বললো – আমাদের সর্বোচ্চ আদালতে প্রেম বিজয়ী হয়েছে। হিলারি রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদদের সাধারণত কোন নৈতিকতা থাকে না, তবে সমাজের নৈতিকতার ব্যাপারে এদের ভালো ধারণা থাকে। তাই মাত্র ১১ বছরের মধ্যে ‘শুধুই নারীপুরুষের পবিত্র বন্ধন’ থেকে বিয়ে হয়ে গেছে ‘সমলিঙ্গের প্রেমের বিজয়’। ১১ বছর আগে যেটা আনএক্সেপ্টেবল ছিল, এখন সেটাই স্বাভাবিক, সেটা বুঝেই হিলারি সুর মিলিয়েছে। এটা শুধু ১১ বছরের না। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে নৈতিকতা, বিশেষ করে যৌনতার ব্যাপারে পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি দেখুন। অবিশ্বাস্য মাত্রার পরিবর্তন দেখতে পাবেন।
একই কথা কিছুটা ভিন্নমাত্রায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ছেলেমেয়ে ভার্সিটিতে উঠে প্রেম করবে, একসময় এটাকে খুব খারাপ মনে করা হত। এখন এটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই প্রেমের স্বাভাবিকীকরনের জন্য এক নতুন ধরণের ভাষাও তৈরি করে ফেলেছি আমরা । “ভাবী ছেলের বিয়ে দিয়েছেন?” “জি ভাবী গত মাসে দিলাম, ছেলের নিজের পছন্দ ছিল।” ক্রমাগত বদলাতে থাকা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে নেয়ার এই হল ফলাফল। আগামীতে সমাজ আর কী কী গ্রহণ করে নেবে তা নিয়েও সহজেই পূর্বাভাস করা যায়। কারণ কোন সোর্সগুলো সামাজিক পারসেপশানকে প্রভাবিত করছে সেটা আমাদের জানা। টিভি, হলিউড-বলিউড, নভেল, গ্লোবাল সেলিব্রিটিদের নিয়ে গসিপ – এগুলোর মাধ্যমে ক্রমাগত একটা নির্দিষ্ট, হাইপার-লিবারেল, অলমোস্ট লিবার্টাইন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিনোদন মনে করে আমরা এগুলোকে নিত্যদিনের অপরিহার্য অংশ বানিয়ে নিয়েছি। বিনোদনের জগত থেকে শেখা “নৈতিকতা”কে বাস্তবে নিয়ে আসছি। এ প্রভাবকে অ্যামপ্লিফাই করছে সোশ্যাল মিডিয়া। একজনের একান্ত অসুখ মহামারীতে পরিণত হচ্ছে। কেউ মেসিকে নিয়ে লাইভে কথা বলে ভাইরাল হচ্ছে, কেউ বৃষ্টিভজা কিসে। কেউ এক্সবক্সে পর্ন দেখে ছোটবোনকে রেইপ করছে।
এই প্রচন্ড ও সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক ও নৈতিক আক্রমণের বিরুদ্ধে আপনার আমার ডিফেন্স যদি হয় “সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা”, “সমাজবাস্তবতা”, “আমাদের সমাজে এসব মানায় না” – তাহলে এ স্রোতে বাঁধ দেয়ার আশা ছেড়ে দেয়া উচিৎ। এই যুক্তি দিয়ে আপনি টিকতে পারবেন না। বরং আপনার যুক্তিই একদিন আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এ অসভ্যতাকে মেনে নিতে বাধ্য করবে। মানুষ বদলায়, সমাজ বদলায়, গ্রহনযোগ্যতার সংজ্ঞা বদলায়, বদলায় অধিকাংশের মত। ভালোমন্দ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মতো ব্যাপারগুলো কি এই বদলাতে থাকা বিষয়গুলোর ছেড়ে দেয়ার মতো ঠুনকো? নাকি এ বিষয়গুলো অপরিবর্তনীয় এবং এক অমোঘ, অপরিবর্তনীয় উৎস থেকে এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা আমাদের কাছে এসেছে?
খুব সহজ করে বলি।
আপনি ভাইরাল হওয়া ছবির বিরোধিতা করেন কারণ তা আমাদের সমাজ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে যায় না? নাকি আপনি এর বিরোধিতা করেন কারণ এটা আল্লাহর অবাধ্যতা – যিনা, প্রকাশ্য ফাহিশাহ এবং সমাজে যিনা ও ফাইশাহ ছড়িয়ে পড়ার কারণ? আপনি কি মানুষের খেয়ালখুশির অনুসরণ করবেন, নাকি আল্লাহর নির্ধারিত হালাল ও হারামের সীমা মেনে চলবেন?
আপনার মাপকাঠি কি মানুষ-সমাজ-অধিকাংশ? নাকি আল-ফুরক্বান?