প্রশ্ন


পর্ব ১

লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

সমাজ ও রাষ্ট্রে ক্রমশ বাড়তে থাকা ইসলামবিদ্বেষ ও সেক্যুলারায়নের মোকাবিলা, এবং বাংলার মুসলিমদের দ্বীন ও আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে হলে কী করণীয়?
এ প্রশ্ন নিয়ে আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রথমেই দরকার নিছক ইস্যুভিত্তিক লেখালেখি, বক্তব্য, হইচই আর কর্মসূচীর প্রবণতা থেকে বের হয়ে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে শেখা। স্বাভাবিকভাবেই সামসাময়িক ইস্যুগুলোর ক্ষেত্রে আবেগ কাজ করে। কিন্তু আবেগ সাময়িক। আবেগ দ্রুত বদলায়। আমাদের প্রয়োজন শরীয়াহর আলোকে, বাস্তবতার নিরিখে ঠান্ডা মাথার যৌক্তিক বিশ্লেষণ। আর কার্যকরী বিশ্লেষণের ভিত্তি হল বাস্তবতা ও বিদ্যমান সমস্যাকে সঠিকভাবে বোঝা।


আমি সংক্ষেপে আমাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু পয়েন্ট বলছি


১। বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে সিস্টেমিক (systemic/নিয়মতান্ত্রিক/কাঠামোগত) ইসলামবিদ্বেষ আছে। সমাজ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা, মিডিয়াতে উপস্থাপন, প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দিকে ইসলামবিদ্বেষ গেঁথে আছে। যেসব ক্ষেত্রে লিখিত বা প্রকাশ্যভাবে ইসলামবিদ্বেষ নেই, সেখানেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অলিখিতভাবে আছে ব্যাপক ইসলামবিদ্বেষ। হিজাব, দাড়ি, ইসলামের বিধিবিধান কিংবা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্য ও ঘৃণামূলক যেসব মন্তব্য, মনোভাব বা অপরাধ আমরা দেখি, সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বরং এই নিয়মতান্ত্রিক ও কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।


২। সক্রিয়ভাবে ইসলামবিদ্বেষ ধারণ করা লোকেরা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু মিডিয়া, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, নাগরিক সমাজ এবং প্রশাসনের বিশাল অংশকে নিয়ন্ত্রন করে এরাই। এই অংশটি সমাজের বাকি অংশকে তাদের কলতাকা ও পশ্চিমা বিশ্বকেন্দ্রিক আকীদাহয় দীক্ষিত করতে চায়। এই ইসলামবিদ্বেষীদের অল্পসংখ্যক হিন্দু কিন্তু অধিকাংশই নামধারী মুসলিম।


৩। বাংলাদেশে বিদ্যমান ইসলামবিদ্বেষের পেছনে দুটি প্রধান শক্তি রয়েছে। একটি অভ্যন্তরীন একটি বাহ্যিক। অভ্যন্তরীনভাবে বাংলাদেশে ইসলামবিরোধীতা প্রতিষ্ঠার পেছনে সক্রিয় শক্তি হল সেক্যুলার-কালচারাল এলিট গোষ্ঠী। যারা নিজেদের প্রগতিশীল, সুশীল সমাজ, ইত্যাদি বলে থাকে। বাংলাদেশে ইসলামবিরোধিতার পেছনে প্রধান বাহ্যিক শক্তি হল ভারত। ভারত তাদের আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থসহ বিভিন্ন কারণে ইসলামকে হুমকি মনে করে। বিশেষ করে তাদের পূর্ব সীমান্তে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির উত্থান ভারতের কাছে অগ্রহণযোগ্য। অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক গোষ্ঠী দুটো একে অপরের সহযোগী।


অ্যামেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটও বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির উত্থানের বিরোধী। দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে তারা ভারতের ঘনিষ্ট মিত্র। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের এবং ভারতের নীতি এক ও অভিন্ন। তবে তাদের বিরোধিতার ধরণ অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করা যায়। অ্যামেরিকা-ইউরোপ মুসলিমদের ওপর যুলুম করে, যেমনটা আমরা আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে দেখেছি। আবার ভারতও মুসলিমদের ওপর যুলুম করে, যেমনটা আমরা কাশ্মীরে এবং বর্তমানে ভারতের ভেতরে দেখছি। দুটোই বিরোধিতা কিন্তু দুটোর ধরণ, মাত্রা, তীব্রতা এক না। তাছাড়া নিকটবর্তিতা এবং ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর ভারত যেভাবে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে, সংগত কারণে পশ্চিমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি।


৪। বাংলাদেশের মুসলিমরা এই যমিনের সন্তান। তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত। মুসলিমরা এবং তাদের অনাগত উত্তরসূরীরা এ মাটিতেই থাকছে, কোথাও যাচ্ছে না। মুসলিমরা এই মাটির ওপর দাবি ছাড়বে না।


৫। মুসলিমরা ইসলাম ছাড়বে না। মুসলিমরা গুনাহগার হতে পারে, কিন্তু ইসলামের কোন বিধানকে অস্বীকার বা অকার্যকর করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। হিজাব-নিকাব-দাড়ি-টুপি থেকে শুরু করে অন্য কোন কিছুই মুসলিমরা ত্যাগ করবে না।


৬। মিডিয়া, মানবাধিকার সংস্থা, বুদ্ধিজীবি, সেক্যুলার বিভিন্ন সেলিব্রিটি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সম্প্রদায়—এদের কেউই মুসলিমদের পক্ষে কথা বলবে না। বরং মুসলিমরা আক্রান্ত হলেও এদের বড় একটা অংশ মুসলিমদেরকেই আগ্রাসনকারী হিসেবে তুলে ধরবে। ৫-ই মে এবং মোদীবিরোধী আন্দোলনের ‘তাণ্ডব’ সংক্রান্ত মিডিয়া কাভারেজ এর জ্বলন্ত উদাহরণ।


৭। সরকার (যেকোনো সরকার)-এর কাছে দাবি জানিয়ে তেমন কোন লাভ নেই। যেকোনো সেক্যুলার সরকার বাংলাদেশের সেক্যুলার-কালচারাল এলিট (ইসলামবিদ্বেষী শক্তি), ভ।রত এবং অ্যামেরিকাকে খুশি রাখার চেষ্টা করবে। কাজেই সরকার বদলালে সাময়িকভাবে কেবল ইসলামবিদ্বেষের মাত্রার পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে গেঁথে যাওয়া কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষের সমাধান হবে না। এসব ক্ষেত্রে সরকার কেবল তখনই মুসলিমদের স্বার্থ আমলে নেবে যখন তারা দেখবে এই ধরনের ইস্যুতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক।


৮। শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে স্ট্যাটাস কৌ (বিদ্যমান অবস্থা) পরিবর্তনের মতো সামাজিক কিংবা অন্য কোন ধরণের সক্ষমতা বাংলাদেশের মুসলিমদের বর্তমানে নেই।


৯। যদি অন্য সকল চলক অপরিবর্তিত থাকে (ceteris paribus), তাহলে বাংলাদেশে ইসলামবিদ্বেষ এবং ইসলাম পালনের কারণে বৈষম্যের শিকার হবার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। ইসলামী বই বেস্টসেলার হওয়া, ফেইসবুকের পোস্টের লাইক-শেয়ার, ইউটিউবে ওয়াজের ভিডিওর ভিউয়ের সংখ্যা বাড়ার মত বিষয়গুলো ইতিবাচক হলেও, এগুলোর মাধ্যমে এ বাস্তবতা বদলাবে না। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে মুসলিমদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের এই কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষের বাস্তবতাকে অবস্থাকে বদলাতে হবে।


১০। শরীয়াহর অবস্থান থেকে সেক্যুলার শাসনব্যবস্থার অংশ হবার সুযোগ নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে কোন ইসলামী রাজনৈতিক দলের পক্ষে বিদ্যমান অবস্থায় এবং নিকটবর্তী ভবিষ্যতে একক ও ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব না। তাছাড়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ ঐতিহাসিকভাবে মুসলিমদের কাজে আসেনি। বরং এতে করে বিদ্যমানতাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। মুসলিমের সীমিত সম্পদ, সময় ও লোকবল এই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে মুসলিমদের নিজস্ব বলয়। কমেছে সমাজ ও রাষ্ট্র ইসলামের প্রভাব। বিকৃতি ঘটেছে মুসলিমদের রাজনৈতিক চিন্তার। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করা ওষুধের বদলে রোগীকে বিষ দেয়ার মতো।


ওপরের ১০টি পয়েন্টের হল পরবর্তী আলোচনা বেইসলাইন বা মূলভিত্তি। এই পয়েন্টগুলোর ব্যাপারে একমত হওয়া সম্ভব হলে, এগুলোকে সামনে রেখে করণীয় এবং সম্ভাব্য কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রেই তারা চিন্তা শুরু করতে পারি।

পরের পর্বের লিঙ্ক