দাওয়াহ কি শুধু “ধর্মীয়” বিষয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে?


পর্ব ১১

লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

মুসলিমদের দাওয়াহ এবং কর্মকাণ্ড কি শুধু “ধর্মীয়” বিষয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে?

সেক্যুলারিসমে ধর্মের অবস্থান ব্যক্তিগত অঙ্গনে সীমাবদ্ধ। সমাজ, শাসন, অর্থনীতির মতো সামষ্টিক বিষয়গুলোকে ধর্মের আওতার বাইরে রাখা সেক্যুলারিসমের অন্যতম মৌলিক অবস্থান। সেক্যুলার চিন্তায় “ধর্মীয়” মানেই মাসজিদ, ঘর আর সীমিত কিছু আচারপ্রথার বিষয়।

কিন্তু এই কথাগুলো ইসলামের ক্ষেত্রে খাটে না।  ইসলাম আমাদের শেখায় মানবজীবনের সব ক্ষেত্রকে ওয়াহীর নির্দেশনা অনুযায়ী চালাতে। আর এর মধ্যে অবধারিতভাবেই শাসন, অর্থব্যবস্থা আর সামাজিক কাঠামোর মত বিষয়গুলো চলে আসে।

ইসলাম তাত্ত্বিকতার ধর্ম না, প্রয়োগের ধর্ম। স্রেফ তাত্ত্বিকভাবে একে বোঝা যায় না। এই দ্বীনের সৌন্দর্যকে সত্যিকারভাবে বুঝতে হলে দ্বীন আকড়ে ধরে বাঁচতে হয়। আধুনিকতা থেকে বের হয়ে আসা অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মত তাত্ত্বিক শাস্ত্র তাই ইসলামে পাওয়া যায় না। তত্ত্বকথা, কাল্পনিক মডেল আর বাদ-মতবাদের বিশাল বিমূর্ত অট্টালিকা ইসলাম তৈরি করে না। কিন্তু তার মানে এই না যে এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে আলোচনা বা নির্দেশনা ইসলামে নেই।

এই ক্ষেত্রগুলোর ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াহ আমাদের কিছু নির্দিষ্ট বিধান এবং সীমানা ঠিক করে দেয়। জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনগুলোর ব্যাপারে দেখিয়ে দেয় সমাধানের নানা পথ। ইসলাম আমাদের এমন কিছু মূলনীতি দেয় পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে যেগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা সম্ভব।

কাজেই ধর্মের জন্য সেক্যুলারিসমের বানানো ছোট্ট খাঁচার ভেতর ইসলামকে ঢোকানো যায় না। ধর্মের জন্য সেক্যুলারিসমের বানানো সীমানা আর দ্বীন ইসলামের সীমানা এক না। সমাজ, শাসন, অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো মুসলিমদের জন্য দ্বীনের বাইরের কোন আলোচনা না। মুসলিমদের দাওয়াহ এবং কাজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়গুলো চলে আসবে।

আকীদাহ, মাসায়েল, তাযকিয়াতুননাফসের মত বিষয়গুলো যেমন ইসলামের অংশ। তেমনি সমাজ, শাসন, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি কিভাবে চলবে, এই আলোচনাগুলোও ইসলামের অংশ। আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর আলোচনা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে গতো আট-নয় দশক ধরে অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলন আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর আলোচনার দিকে খুব একটা মনোযোগী হয়নি বা হতে পারেনি। এর পেছনে বিভিন্ন বাস্তবসম্মত কারণ আছে। আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াহর দেয়া সমাধানগুলো অবধারিতভাবে ইসলামী শাসনের সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী শাসনকে বাদ দিয়ে এই সমাধানগুলোর আলোচনা অনেকটা গাছ না লাগিয়ে ফল আশা করার মতো।

তাছাড়া আধুনিক জাতিরাষ্ট্র এমন এক বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে যা মৌলিকভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যার ইসলামী সমাধানগুলোআধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা অনেক সময়ই তাই স্ববিরোধী হয়ে পড়ে। এই বিষয়ের ওপর ওয়ায়েল হাল্লাক্ব বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, সেগুলো দেখা যেতে পারে[1]

এসব কারণে ইসলামী আন্দোলনগুলো অল্প কিছু বিষয়ের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে নিয়েছে। মুসলিমদের দাওয়াতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে কমেছে আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর উপস্থিতি। আজ দ্বীনি শিক্ষা, ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালনের দাওয়াহ এবং সাদাকাহ-যাকাত সংক্রান্ত কিছু উদ্যোগের মধ্যেই আমাদের অধিকাংশ কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে, একথা বললে ভুল বলা হবে না।

কারণ যাই হোক, সমাজের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নেতিবাচক। এর ফলে মানুষের চিন্তার জগতে নিজে থেকেই এক ধরণের বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। মানুষ ধরেই নিয়েছে অর্থনীতি, সামাজিক সমস্যা, শাসন, যুলুমের মোকাবেলার মত বিষয়গুলোর সমাধানের পথ হল সেক্যুলার রাজনীতি। এগুলোর জন্য যেতে হবে সেক্যুলার রাজনীতির পথে। আর ইসলামী ব্যক্তিত্ব বা সংগঠনগুলোর কাছে মিলবে কেবল “ধর্মীয়” বিষয়ের সমাধান।

আমরা নিজেরাও অনেক সময় এই বিভাজনকে শক্তিশালী করি। সমাজে আলিমদের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আমরা যেমন বলে ফেলি – আলেমরা ছাড়া জানাযা পড়াবে কে?

অথচ আলিমদের ভূমিকা কিছু ধর্মীয় আচার পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। তাদের দায়িত্ব এবং সম্মান আরো অনেক বিস্তৃত। কিন্তু আমরা নিজেরাই এসব কথা বলে তাঁদেরকে অনেকটা আচারসর্বস্ব পুরোহিতের জায়গায় নামিয়ে আনি। ইসলামী জ্ঞানের প্রয়োগকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা থেকে।

এই ধরণের চিন্তার অবধারিত ফলাফল হল সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রন সেক্যুলার শ্রেণীর হাতে চলে যাওয়া। গত আট-নয় দশকে উপমহাদেশে ঠিক তাই ঘটেছে। আর বিভিন্ন সেক্যুলার দল ও গোষ্ঠী তাদের আকীদাহ এবং এজেন্ডা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। আর্থ-সামাজিক বিষয়ে ইসলামের জায়গা থেকে কথা বলার সুযোগও দিন দিন কমে এসেছে।  

অথচ ব্যাপারটা সবসময় এমন ছিল না। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী শাসন যখন ছিল, সেই সময়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম, কলোনিয়াল দখলদারিত্বের সময়ও দ্বীনি ও দুনিয়াবি দু ধরণের ইস্যুকে ইসলামের ভিত্তিতে সমন্বয় করে আন্দোলনের অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। আর্থ-সামাজিক যুলুমের বিরুদ্ধে দ্বীনের ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত আছে আল-জাযায়েরী, আল-খাত্তাবী, ইমাম শামিলসহ আরো অনেকের আন্দোলনের মাঝে। আমাদের হাতের কাছেই আছে শহীদ তিতুমীর এবং ফরায়েজী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত।

ইমাম সাইয়্যিদ আহমাদ শহীদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলন ছিল একটি সফল কৃষক আন্দোলনও। অন্যদিকে আরবের নাজদী আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হাজী শরীয়াতুল্লাহর তাজদীদি আন্দোলন শুরু হয়েছিল বাংলার জনগণকে শিরক ও বিদআহ থেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু একসময় এই আন্দোলন মনোযোগী হয় আর্থ-সামাজিক নানা বিষয়ের দিকেও। দুদু মিয়ার স্লোগান, ‘লাঙ্গল যার, জমি তার’, স্পষ্টতই নীলকর এবং জমিদারদের যুলুমের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক সমাজের মনোভাব মাথায় রেখেই তৈরি করা। আর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়টাতেই ফরায়েজী আন্দোলন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় পৌছে।

বাস্তবতা বলে “দ্বীনি-দুনিয়াবি” ইস্যুর এই বিভাজনকে টিকিয়ে রেখে ইসলামকে সামাজিক শক্তি হিসেবে দাড় করানো অত্যন্ত কঠিন। অধিকাংশ মানুষ আদর্শ বা আকীদাহ দ্বারা চালিত হয় না। ক্ষুধার্থ মানুষ, নয়টা-পাচটার রুটিনের যাতাকলে ক্লান্তশ্রান্ত মধ্যবিত্ত, চাইলেও কেবল আকীদাহর ওপর শক্ত অবস্থান নিতে পারে না।

এই মানুষগুলোকে কাছে টানতে হলে কথা বলতে হবে তাদের দুশ্চিন্তা, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো নিয়েও। বিপদের সময় তাদের পাশে দাড়াতে হবে। পাশাপাশি ইসলামকে উপস্থাপন করতে হবে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমাধান হিসেবেও। যাতে অর্থনীতি, সমাজ, শাসনের নানা সমস্যার বাস্তব সমাধান হিসেবে ইসলামের কথা চিন্তা করার প্রবণতা সমাজের মধ্যে তৈরি হয়। এই অঙ্গন সেক্যুলারদের জন্য ছেড়ে দিয়ে রাখলে সমাজ ও শাসনের নিয়ন্ত্রন তাদের হাতেই থেকে যাবে।


[1] ইংরেজি – The Impossible State

আরবী – الدولة المستحيلة: الإسلام والسياسة ومأزق الحداثة الأخلاقي (وائل ب.حلاق)

পরের পর্বের লিঙ্ক