কিছু টীকা ও সংযুক্তি


পর্ব ১৫

লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

ইসলামকে সামাজিক শক্তি হিসেবে হাজির করার লক্ষ্যে অফলাইনের কাজের ব্যাপারে আরো কিছু পয়েন্ট—

১। এই কাজগুলোর মূল উদ্দেশ্য হল, সাধারন মানুষের কাছে পৌছানো। যারা ইতিমধ্যে ইসলাম বোঝে, পালন করে এবং সার্বিকভাবে ইসলাম চান, তারা মূল টার্গেট অডিয়েন্স না। চিন্তাগুলোকে ইসলামপন্থীদের নিজস্ব ছোট্ট বলয় থেকে বের করে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া অত্যন্ত জরুরী। সমাজের সবাইকে কনভিন্স করা গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু সবার কাছে এই কথাগুলো পৌছানো গুরুত্বপূর্ণ।

২। অফলাইনের এই কাজগুলোর আরেকটা মৌলিক উদ্দেশ্য হল সাধারণ মানুষের চিন্তার ধরণকে পালটে দেয়া (মেটাপলিটিকস সংক্রান্ত আলোচনা দ্রষ্টব্য)। এই কাজগুলো করা হবে সেই মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য। কাজগুলো মাধ্যম, মূল উদ্দেশ্য না। কথাটা সহজ, কিন্তু বোঝার ক্ষেত্রে এর সূক্ষ কিছু দিক আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে যেতে পারে।

৩। অনেককাজের ক্ষেত্রে ওভারল্যাপ থাকতে পারে এবং আছে । প্রত্যেক টপিকের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যাটফর্ম করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। একই ক্লাব/কেন্দ্র/প্ল্যাটফর্ম একাধিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারে। কোন প্ল্যাটফর্ম কী কী টপিক নিয়ে কাজ করবে, তা নির্ভর করবে তাদের নিজস্ব লোকবল, সক্ষমতা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। তবে অনেকেই একসাথে অনেক কাজ করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যান, তারপর আর তেমন কিছুই করা হয়ে ওঠে না। তাই এক বা দুটা টপিক নিয়ে ফোকাস করাই প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো হবে বলে মনে হয়।

৪। কাজ যে ফরম্যাটেই হোক আদর্শ হিসেবে ইসলাম এবং মুসলিম পরিচয়ের কথা কেন্দ্রে থাকতে হবে। কথিত হিকমাহর নামে ইসলামকে গোপন করা যাবে না। যেমন: মাদকাসক্তি, পর্নআসক্তি কিংবা ডিপ্রেশনের সমাধানের আলোচনায় কেবল বৈজ্ঞানিক রিসার্চ, ব্যক্তিগত সাফল্যব্যর্থতার মত বিষয়গুলোর আনলে চলবে না। এগুলো আলোচনায় অবশ্যই থাকবে, কিন্তু অন্ধকারগুলো থেকে বের হয়ে আসার মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে ইসলাম।

৫। এই ধরণের উদ্যোগে মাদ্রাসা (কওমী, আলিয়া) এবং সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত, দু ধরণের ব্যাকগ্রাউন্ডের মুসলিমদের সাথে নিয়েই করতে হবে। বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম এবং দলগুলোর সাফল্য এবং ব্যর্থতার ইতিহাস থেকে এটা স্পষ্ট যে, কেবল কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক উদ্যোগ ইসলামকে সামাজিক শক্তি হিসেবে হাজির করার জন্য যথেষ্ট না। অন্যদিকে মাদ্রাসার সাথে যুক্ত বিশাল সংখ্যক আলিম এবং ছাত্রদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশে কোন ইসলামী উদ্যোগ গ্রহণ বাস্তবসম্মত না। একমুখী চিন্তা কার্যকরী হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।

৬। মাযহাব-মাসলাকভিত্তিক পার্থক্য এবং এধরণের ঐতিহাসিক তর্কগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। আমার মতে বর্তমানে এগুলোর অবস্থা জাহিলিয়্যাহর সময়কার গোত্রীয় বিরোধের মতো হয়ে গেছে। একবার গোত্র নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হলে বিবেচক মানুষদেরও সংঘাতে জড়িয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে।

৭। কাজ করতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা, সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর আধিপত্য এবং মিডিয়ার প্রপাগ্যান্ডার ক্ষমতা মাথায় রেখে। অফলাইনে কাজের ক্ষেত্রে যেকোন ধরণের সংঘর্ষ যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্টাই উত্তম। তবে এটার মানে এই না যে, ঝামেলা হতে পারে এই চিন্তায় কাজই শুরু করা হল না। কাজ করতেই হবে, তবে সেটা যথাসম্ভব ঝামেলা এড়িয়ে।

৮। আমরা বলেছিলাম সেক্যুলারদের সামাজিক আধিপত্য ভাঙার জন্য সাংস্কৃতিক যুদ্ধ— মেটাপলিটিকাল সংগ্রাম—অনলাইন এবং অফলাইন দু’জায়গাতেই করতে হবে। ভাঙ্গা আর গড়া, দুটোই এই যুদ্ধের অংশ। মোটা দাগে বিষয়টা এভাবে ভাগ করা যায় –

– ভাঙার কাজটা মূলত হবে অনলাইনের অ্যাকটিভিটির মাধ্যমে।

– গড়ার কাজটা বা সামাজিক শক্তি হিসেবে ইসলামকে হাজির করার ব্যাপারটা হবে অফলাইন কাজের মাধ্যমে

এই বিভাজন সবসময় ১০০ তে ১০০ হয়তো থাকবে না, তবে এটাকে মূলনীতি হিসেবে নেয়া যায়। তাই অনলাইনে সেক্যুলারদের আদর্শকে খণ্ডন বা নাকচ করার ক্ষেত্রে আক্রমনের তীব্রতা থাকবে। কিন্তু অফলাইনে এই তীব্রতা এড়িয়ে যেতে হবে।

৯। আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলামী সমাধান নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক লিটারেচার ও ম্যাটেরিয়াল দরকার। আরবীর পাশাপাশি ইংরেজিতে এমন অনেক ম্যাটেরিয়াল আছে। এগুলো প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলায় রূপান্তরিত করার কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আন্তরিক, পরিশ্রমী এক দল মানুষ দরকার। যাদের হাহুতাশ কিংবা অজুহাতবাজি করার সময় নেই, যারা জ্বরগ্রস্থের মতো কাজ করবে।

১০। মিছিল, সমাবেশসহ বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচীতে স্লোগান, পতাকা, প্রতীক ব্যবহারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কালচাড়াল জমিদারদের নেতিবাচক প্রচারণার ফলে একটা পতাকার ছবি কিংবা একটা স্লোগানের সাউন্ডবাইট অনেক গুরুতর কিছু হয়ে দাড়াতে পারে। তাই এধরণের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে সব দিকে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ। শক্তির অবস্থান থেকে দাওয়াহ আর দুর্বলতার অবস্থান থেকে দাওয়াহর প্রকাশভঙ্গি এক রকম হয় না। আমরা এখন দুর্বল, এটা মাথায় রেখেই কাজ করা দরকার।

১১। অপটিকস (optics) এবং অ্যাস্থেটিকস (aesthetics) গুরুত্বপূর্ণ। হিটলারের সবচেয়ে কড়া সমালোচকও স্বীকার করে নাৎসিদের পতাকার ডিযাইন, তাদের নিজস্ব স্যালুট, পোষাক, তাদের আয়োজিত কর্মসূচীর আমেজ ও অনুভূতি জনসাধারণের মাঝে প্রভাব বিস্তারে অত্যন্ত কার্যকরী ছিল। হিটলার বা নাৎসিরা আমাদের আদর্শ না। কিন্তু তাদের ঘটনা একটা বাস্তব উদাহরণ যে কিভাবে পোশাক, এবং আচরণের মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করা যায়। দাওয়াহ দেয়া যায়। এবং এই শিক্ষা আমরা আগেই সুন্নাহ থেকে জানি। কিন্তু কেন জানি আমরা অনেকেই এটা গুরুত্ব দিতে চাই না। ইসলামের বাহ্যিক শিয়ার(চিহ্ন-পরিভাষা এবং বিশেষ করে লেবাস) গুলো আকড়ে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।

১২। বাংলাদেশের মানুষের বড় একটা সমস্যা হল যেকোন কাজকে আমলাতান্ত্রিক গোলকধাঁধা বানিয়ে ফেলা। লিফলেট বিলি করার মতো একটা ছোট উদ্যোগকে নিয়ে দেখা যাবে মিটিং এর পর মিটিং হচ্ছে, কমিটি-সাবকমিটি-বাজেট কমিটি, নানা কাহিনী। এসব করতে করতে কাজ আর হচ্ছে না। অথবা দেখা যায়, কোন একটা বিষয় নিয়ে খুব উৎসাহের সাথে মিটিং হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে, আলোচনা শেষে করণীয় ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু এতোসব কিছুর পর অ্যাকচুয়াল কাজে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিন্তু সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নেই। এই ধরণের আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অনেক সময় কাজে সফলতার জন্য সাধ্যমত প্রস্তুতি নিয়ে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে জাস্ট কাজে নেমে যেতে হয়।

১৩। অফলাইনের সব ধরণের উদ্যোগ এবং কাজগুলোকে অনলাইনের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে। এই ধরণের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরণের ডিসাইন করা, স্লোগান তৈরি, হাইপ তোলা, মার্কেটিং করা, অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গবেষণা করা, বিভিন্ন যুক্তিতর্ক তৈরি করে দেয়া—এগুলো অনলাইন কমিউনিটি নিজ উদ্যোগে করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে হাইপ বা প্রচারের ক্ষেত্রে যেন স্ট্র্যাটিজিক ওভাররীচ না হয়। আমরা এমন হাইপ তুললাম যে কাজের শুরুতেই জমিদাররা নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করলো – এমন বোকামী করা যাবে না।

আবারো মনে করিয়ে দেই, শক্তির অবস্থান থেকে দাওয়াহ আর দুর্বলতার অবস্থান থেকে দাওয়াহর প্রকাশভঙ্গি এক রকম হয় না। আমরা এখন দুর্বল।

১৪। আজকাল দেখা যায় একট ছোট লেখা অনুবাদ করা, সাবটাইটেল বসানো বা ডিসাইনের কাজ করতে দিলে মানুষ টাকা চেয়ে বসে। টাকা চাওয়া সর্বাবস্থায় ভুল না, এবং অনেক ক্ষেত্রেই যৌক্তিক। অনেক কাজ আছে যেগুলো সময়সাপেক্ষ এবং এতে যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এধরণের কাজ কাউকে ফ্রি-তে করিয়ে নেয়া এক অর্থে যুলুম হয়ে দাড়ায়। কিন্তু ইসলামী দাওয়াহর কাজের ক্ষেত্রে যদি একেবারেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা না থাকে, তাহলে কাজ আগানো কঠিন হবে।

১৫। আত্মপ্রচার, সেনসেশানালিসম, পপুলিসমের মতো বিষয়গুলো তালাক দিয়ে এই কাজে নামতে হবে। কাজগুলো খালিসভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং দ্বীনের জন্য না হলে, সাফল্যের আশা করা সম্ভব না। যারা শুধু নিজের বড়ত্ব, মহত্ব, কৃতিত্ব যাহির করতে ব্যস্ত, “আমি-আমার” এর চক্করে যারা আটকে গেছেন, নিজের মার্কেটিং ছাড়া যারা অন্য কিছুতে তেমন একটা আগ্রহী না, যারা যেকোন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রোফাইল বাড়ানোর চিন্তার বাইরে বের হতে পারে না, অথবা যারা যেকোন কিছুতে নিজের দল বা গোষ্ঠীর কৃতিত্ব যাহিরে উদগ্রীব—এই ধরনের মানুষদের যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া উচিৎ।

পরের পর্বের লিঙ্ক