পর্ব ৩
লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে
হিজাব এবং নিকাব পালনের কারণে মুসলিম নারীদের হয়রানি এবং তাঁদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ নতুন না। দশ বছর আগেও এমন খবর আমরা দেখতাম। এখনো দেখি। তবে ইসলামবিদ্বেষী এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আজ কলকাতামুখী সেক্যুলারিসমের চর্চা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ফিরিঙ্গিদের স্নেহধন্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, মফস্বলের স্কুল থেকে শুরু করে জেলা শহরের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়-ইসলামের বিধান পালনের কারণে মুসলিম নারীদের হয়রানি করা সব জায়গাতেই।
ধরুন, এসবের প্রতিবাদে কোন কর্মসূচীর আয়োজন করা হল। মানববন্ধন, সভা-সমাবেশের মত নিরীহ কিছু। অথবা ধরুন, কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষের মোকাবিলার জন্য তৈরি করা হল কোন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ইসলামবিদ্বেষের ঘটনাগুলো মনিটর করবে, ডেইটাবেইস তৈরি করবে, এ ব্যাপারে বিভিন্ন গবেষণা করবে পাশাপাশি বিভিন্ন সভা-সেমিনার, প্রতিবাদ কর্মসূচী ইত্যাদির আয়োজন করবে। কাজগুলো করা হবে সম্পূর্ণভাবে দেশীয় আইনকানুনের ভেতরে থেকেই।
কাগজেকলমে এই ধরনের কাজে কোন সমস্যা থাকার কথা না। কিন্তু আপনি এবং আমি, আমরা দুজনেই জানি ‘উগ্রবাদী’ ট্যাগ লাগিয়ে এই পুরো প্রকল্পকে ভেঙ্গেচুড়ে দেয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর আছে। ধরা যাক, এই ধরণের কর্মকাণ্ড একটা সীমা পর্যন্ত মেনে নিতে সরকারের সমস্যা নেই। যেহেতু তারা এটাকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে না। তবু দেখবেন বাংলাদেশের সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী নানা হইহুল্লোড় আর স্টান্টবাজি করে ঠিকই রাষ্ট্রযন্ত্রকে টেনে নিয়ে আসবে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে।
তারপর কী হবে?
হয়তো একেবারে নিরীহ ইস্যুতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তরুণরা গ্রেফতার হবে। তারপর সেই তরুণদের মিডিয়াতে ফলাও করে জঙ্গি প্রমাণ করা হবে। তাদের কে কয়টা বিয়ে করেছে, ফেইসবুকে কে কোথায় লাইক দিয়েছে, কার বিরুদ্ধে এলাকার কোন মাস্তান অভিযোগ করেছে, সব কিছু মিলিয়েমিশিয়ে এক খিচুড়ি বানিয়ে মিডিয়া সেটা মানুষের সামনে পরিবেশন করবে। সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী বাস্তবতাকে দুমড়ে মুচড়ে তৈরি করবে পরাবাস্তব এক গল্প।
এক সময় বাস্তবতা হারিয়ে যাবে, আর সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর নির্দেশনায় মিডিয়ার তৈরি করা এই ক্যারিক্যাচারকেই সাধারণ মানুষ সত্য মনে করবে। সামাজিক ন্যারেটিভ নির্মান আর সামষ্টিক স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা, এর উৎস হল সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের কালচারাল হেজেমনি বা সামাজিক আধিপত্য।
বাংলাদেশের সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর মূল শক্তির জায়গাটা এখানেই। বাংলাদেশে এমন এক সামাজিক কাঠামো তারা তৈরি করেছে যেখানে খুব সহজে মুসলিমদের ‘অপর’, ‘অদ্ভূত’ কিংবা ‘শত্রু’ প্রতিপন্ন করা যায়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবলীলায় এমন সব কথা বলা যায় এবং কাজ করা যায়, যা অন্যদের ক্ষেত্রে করা যায় না। সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলিমদের ইসলামের জায়গা থেকে কথা বলার সুযোগ থাকে না। আমাদের কন্ঠ রোধ করার সর্বাত্বক চেষ্টা সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী করতে থাকে।
এই সব কিছুর ফলাফল হল ইসলাম এবং মুসলিমদের প্রতি সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনী বৈষম্য ও বিরোধিতা। সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী একটা সীমিত সীমানার ভেতরে কিছু আচার-আচরণ ও কথাকে ‘অনুমোদিত ইসলাম’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর বাইরে আর সব কিছু “অননুমোদিত ইসলাম”। কোন ইসলাম অনুমোদিত এবং কোন ইসলামকে অননুমোদিত মনে করা হয়, তার সাথে ইসলামের মূল উৎসগুলোর, অর্থাৎ শরীয়াহর দলিলের কোন সম্পর্ক নেই। মুসলিমদেরও এর ওপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এগুলো পুরোপুরিভাবে সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে।
সেক্যুলার-প্রগতিশীল শ্রেণীর এই সামাজিক আধিপত্যের কারণে নিজেদের ওপর যুলুম হলেও সেটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ আমাদের মুসলিমদের নেই। নবীজি (ﷺ)-এর অবমাননা কিংবা হিজাব-নিকাবের মতো ইস্যুতেও মুসলিমরা রাস্তায় নামতে পারে না। নামলেই নিমিষেই জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে তাদের জেলে বন্দী করে ফেলা যায়। দেশের আর্থ-সামাজিক ইস্যুতে ইসলামের জায়গা থেকে সম্ভাব্য সমাধান বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলা তো অনেক দূরের কথা, মুসলিম পরিচয়কে জাতীয় আলোচনায় শক্তভাবে আনারও কোন উপায় আমাদের সামনে খোলা নেই। সেক্যুলার-জমিদার শ্রেনী সব পথ বন্ধ করে রেখেছে।
সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর এই কালচারাল হেজেমনি বা সামাজিক আধিপত্য হল আমাদের গলায় আটকানো ফাঁসের মতো। যেই ফাঁস আমাদের নিঃশ্বাস নিতে দেয় না। কথা বলতে দেয় না। স্বাধীনভাবে চলতে দেয় না। ইচ্ছেমতো তারা এই ফাঁস গুটিয়ে আনে, কখনো কখনো আলগা করে। আর আমাদের অসহায়ের মতো অপেক্ষা করতে হয়…কখন জমিদারবাবুরা একটু কৃপা করে ফাঁস আলগা করবেন আর আমরা নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ পাবো। এ এক অপমানজনক, দাসত্বের জীবন।
অথচ এই দ্বীন যেমন আমাদের তেমনি এই যমিনও আমাদের।
তাই গলায় আটকে থাকা এই ফাঁস ছিড়ে ফেলার চিন্তাকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোন করনীয়ের কথা বলা অর্থহীন।