কালচারাল হেজেমনি মোকাবিলার প্রতীক হিসেবে শহীদ তিতুমীর


পর্ব ৫

লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে

বাংলায় ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্ত হবার পর বেসামরিক প্রশাসন থেকে মুসলিম কর্মকর্তাদের বের করে দেয়া হয়। অন্যদিকে ইংরেজরা তাদের চতুর নীতির মাধ্যমে তৈরি করে নগরকেন্দ্রিক হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেনী। এই ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করে ইংরেজরা অন্যান্য সম্প্রদায়কে শোষণ করতে থাকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সারা দেশে তৈরি করা হয় হিন্দু জমিদার শ্রেনী। ভূমি রাজস্ব ও প্রশাসন চলে যায় হিন্দু কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের হাতে। এদের অধিকাংশ ছিল ব্রিটিশ, অবাঙ্গালি ও মারোয়াড়িদের গোমস্তা বা ম্যানেজার।

এতে মুসলিম উচ্চবিত্ত শ্রেনী অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর প্রভাব পরে পুরো মুসলিম সমাজেই। বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির জায়গীর এবং মদদ-ই-মাআশ সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় গ্রামীন এলাকার অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াকফ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। ক্বাযী, মুফতি ইত্যাদি হিসেবে আলিমদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়। সীমিত হয়ে আসে তাঁদের সামাজিক প্রভাব।

এভাবে কাঠামো উলোট-পালোট হয়ে যায় বাংলার মুসলিম সমাজের কয়েক শ’ বছরের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো। ইংরেজদের অনুগত হিন্দুরা মুসলিমদের ওপর আধিপত্য কায়েম করে।

মুসলিমদের জীবন এবং দ্বীন পালনের ক্ষেত্রেও হিন্দু আধিপত্যের বিভিন্ন প্রভাবে পড়তে শুরু করলো। সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর যে সময়টাতে আন্দোলন গড়ে তোলেন তখনকার মুসলিম সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যাক –

  • সালামের বদলে মুসলিমদের মধ্যে নমস্কারের প্রচলন
  • নামের আগে ‘শ্রী’-ব্যবহারের প্রবণতা
  • মুসলিম তরুণদের বিভিন্ন পৌত্তলিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ
  • মুসলিমদের মধ্যে হিন্দুয়ানী বাংলা নামের প্রচলন। যেমন নবাই রুপাই, চাপা, মুক্তা, ইত্যাদি। তিতুমীরের অনুসারীদের মধ্যেও এমন নাম দেখা যায়।

সেই সময়ের সাথে আজকের পার্থক্য থাকলেও, আমাদের বর্তমানেও এধরনের কিছু প্রবণতা কিন্তু দেখা যায়। যেমন,

  • মঙ্গল শোভাযাত্রা, হোলির মতো অনুষ্ঠানে মুসলিম তরুণদের অংশগ্রহণ।
  • ধর্ম যার যার উৎসব সবার-এর স্লোগানে বিভিন্ন পৌত্তলিকতার স্বাভাবিকীকরণ।
  • সন্তানের নাম দেয়ার ক্ষেত্রে বলিউড কিংবা পশ্চিমবঙ্গের সিরিয়ালগুলো অনুকরণের প্রবণতা, ইত্যাদি।

তিতুমীরের সময়ে ফেরা যাক। তখনকার হিন্দু জমিদাররা মুসলিমদের ওপর বিভিন্ন পৌত্তলিক কর চাপিয়ে দিয়েছিল। যেমন দুর্গাবৃত্তি, কালিবৃত্তি, ‘পৈতা খরচ’, শ্রাদ্ধ খরচা ইত্যাদি। জমিদাররা গরু জবাই করাও নিষিদ্ধ করে। তিতুমীরের আন্দোলন শুরু হবার পর নতুন নতুন আরো অনেক কর চাপানো হয়। যেমন-

  • দাড়ি রাখলে জমিদারকে ট্যাক্স দিতে হবে!
  • দাড়ি রেখে গোঁফ ছাটলে পাঁচ শিকা খাজনা দিতে হবে।
  • ‘বাঙ্গালি’ নাম বদলে ‘ওহাবি’ মতে আরবী নাম রাখলে নাম প্রতি পঞ্চাশ টাকা জমিদারকে দিতে হবে, ইত্যাদি।

সরফরাজপুরে তিতুমীর রাহিমাহুল্লাহ একটি মাসজিদ গড়ে তোলেন। এটি ছিল তাঁর আন্দোলনের দাওয়াতি কেন্দ্র। জমিদার কৃষ্ণদেব রায় দলবল নিয়ে জুমুআর সালাতের সময় সেই মাসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। দুই জন মুসলিম মারা যান। আহত হন আরো অনেকে। ইংরেজদের কাছে অভিযোগ জানানোর পর বরাবরের মতোই তারা তা উপেক্ষা করে এবং তাদের অনুগত হিন্দু জমিদার শ্রেণীর পক্ষ নেয়। এই ঘটনার পরই সশস্ত্র রূপ নেয় তিতুমীরের আন্দোলন।

শহীদ তিতুমীর রাহিমাহুল্লাহর সময় ও সমাজের সাথে আমাদের বর্তমানের অনেক পার্থক্য আছে। তবে মিলও আছে কিছু।

আমাদের সমাজেও আজ আধিপত্য কায়েম করেছে করছে পশ্চিমা বিশ্ব, গেরুয়াবাদী শক্তি আর তাদের এজেন্টদের সমর্থন পাওয়া এক জমিদার শ্রেনী। এই শ্রেনী নামে হিন্দু না তবে সাংস্কৃতিকভাবে নিশ্চিতভাবেই পৌত্তলিক।

এই সেক্যুলার-প্রগতিশীল শ্রেনী ইসলাম এবং মুসলিমদের ঘৃণা করে কৃষ্ণদেব রায়দের মতো করেই।

দুশো বছর আগের জমিদারের মতো আজকের সাংস্কৃতিক জমিদাররাও মুসলিমদের ওপর তাদের পৌত্তলিক সংস্কৃতি ও আচার চাপিয়ে দিতে চায়। এবং তারা এতে অনেকাংশে সফলও।

দুশো বছর আগে ‘কর্তৃপক্ষ’ যেমন অনুগত জমিদার শ্রেনীকে সমর্থন জুগিয়ে যেত এবং মুসলিমদের নিয়ন্ত্রনের জন্য ব্যবহার করতো, আজো তাই।

তিতুমীর রাহিমাহুল্লাহ মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক প্রভাব এবং জমিদারদের আধিপত্য মোকাবিলায় কী করলেন?

তিনি তাঁর অনুসারীদের দাড়ি রাখতে বললেন। ধুতি দুই পায়ের মাঝ দিয়ে টেনে পরতে মানা করলেন। গিড়ার ওপর কাপড় রাখতে বললেন। অর্থাৎ, তিনি তাঁর অনুসারীদের নিজেদের মুসলিম পরিচয় বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করার শিক্ষা দিলেন। আর বর্জন করতে বললেন মুশরিকদের পোশাকরীতি, আচারঅনুষ্ঠান এবং সংস্কৃতি। পাশাপাশি বললেন শিরকি উৎসবের সাথে জড়িত সব ধরনের কর দেয়া বন্ধ করে দিতে।

সামাজিক দিকগুলোর পাশাপাশি তিনি আকীদাহগত শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি যেসব শিক্ষার ওপর বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন সেগুলো হল–

ক) সমস্ত ইবাদাহ এবং শ্রদ্ধা কেবল আল্লাহর জন্য

খ) যেকোন ধরনের শিরক থেকে বিরত থাকা

গ) ফাতেহা, ওরশ, মহররম, মিলাদে কিয়াম, ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা

দেখুন তিতুমীর কিন্তু জমিদার বা হিন্দু সমাজের চালু করা সংস্কৃতিকে ‘ইসলামীকরণ’ করার চেষ্টা করেননি। বরং জমিদারদের গড়ে তোলা ফ্রেইমওয়ার্ক বা কাঠামোকেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। নিজের আকীদাহ এবং মুসলিম পরিচয়ের সাথে তিনি আপোস করেননি। বরং একেই বানিয়েছেন আন্দোলনের মূল ভিত্তি। স্রোতের সাথে তাল মেলানোর জন্য তিনি আগডুম-বাগডুম ব্যাখ্যা টানেননি। বরং শিরক ও বিদআত মুক্ত সমাজ এবং বিশুদ্ধ তাওহিদ ও সুন্নাহর অনুসরণের শিক্ষা প্রচার করেছেন।

তিতুমীর মাথা নিচু করেননি। হাত কচলে, মেরুদণ্ড বাঁকা করে বাবুদের জাতে ওঠার চেষ্টা করেননি। সরাসরি জমিদারদের চোখে চোখ রেখে তাদের চ্যালেঞ্জ করেছেন।

শহীদ তিতুমীরের প্রেক্ষাপট এবং পদ্ধতির অনেক কিছুই আমাদের জন্য বর্তমানে প্রযোজ্য না। কিন্তু তিতুমীরের আপোসহীন ও অদম্য চেতনা থেকে আমাদের নিঃসন্দেহে অনেক কিছু শেখার আছে। সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের কালচারাল হেজেমনি মোকাবিলায় আমাদের জন্য মডেল হতে পারেন শহীদ তিতুমীর রাহিমাহুল্লাহ এর শিক্ষা।

সাংস্কৃতিক জমিদারদের ঠিক করে দেয়া সংজ্ঞা মেনে নিজেদের ‘বাঙ্গালি’ প্রমাণের গরজ আমাদের নেই। কৃষ্ণদেব রায়দের খুশি করার জন্য দ্বীনের সাথে আমরা আপোস করবো না। আমরা এ মাটির সন্তান। এ সমাজ, অর্থনীতি আর দেশে আছে আমাদের আর আমাদের পূর্বপুরুষের অবদান। আমরা হাজার বছরের গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। আমাদের শাসনামলেই এই উপমহাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রমাণ হিসেবে এগুলো যথেষ্ট।

এই দ্বীন আমাদের, এই যমিনও আমাদের।

পরের পর্বের লিঙ্ক