পর্ব ৬
লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে
‘কালচার ওয়ার’ (সাংস্কৃতিক যুদ্ধ) শব্দগুলো এসেছে জার্মান Kulturkampf (কুলট্যুরকাম্ফ) থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ক্যাথলিক চার্চের সাথে প্রুশিয়ার সেই সময়কার শাসক অটো ভন বিসমার্কের দ্বন্দ্ব বেশ তীব্র হয়ে দাঁড়ায়। এই দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ ছিল ক্যাথলিক চার্চের শিক্ষাব্যবস্থা এবং স্বায়ত্তশাসনের ওপর সেক্যুলার সরকারের হস্তক্ষেপ।
তবে Kulturkampf বলতে এখন আর কেউ উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের ঝাপসা হয়ে আসা কোন অধ্যায়কে বোঝায় না। কালচার ওয়ার বা সাংস্কৃতিক যুদ্ধের অর্থ আজ বদলে গেছে। কোন মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং আচরণগুলো সমাজে কর্তৃত্ব করবে তা নির্ধারনের জন্য যে আদর্শিক যুদ্ধ, সেটাকেই এখন কালচার ওয়ার বা সাংস্কৃতিক যুদ্ধ বলা হয়।
এ যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলো লড়াই করে সমাজে নিজ নিজ বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচরণের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। এই লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ঐ সমাজের আত্মপরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করা। এই লড়াইয়ের ফলাফল ঠিক করে দেয় ঐ সমাজের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। এই যুদ্ধের সংঘর্ষগুলো হয় ঐ ধরণের বিষয়ে যেগুলো নিয়ে সমাজে আছে তীব্র মতপার্থক্য। যেগুলোকে কেন্দ্র করে সমাজে মেরুকরণ ঘটে।
সাম্প্রতিক সময়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের সবচেয়ে চোখে পড়ার মত উদাহরণ অ্যামেরিকা। বেশ কয়েক দশক বছর ধরে অ্যামেরিকায় দুটো পরিচয়ের সংঘাত চলছে। একদিকে রক্ষণশীল অ্যামেরিকা যারা খ্রিষ্টান এবং কিছুটা বর্ণবাদী। অন্যদিকে প্রগতিশীল অ্যামেরিকা, যারা পুরোপুরিভাবে লিবারেল-সেক্যুলার মূল্যবোধ ধারণ করে। এক দিকে অ্যামেরিকার প্রাণকেন্দ্রের মধ্যবিত্ত সাদারা, অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের এলিটরা।
এই দুই অ্যামেরিকা নিজ নিজ মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং আচরণের আধিপত্যের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। আর এই লড়াই হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক ও ‘কালচারাল’ ইস্যুকে কেন্দ্র করে। যেমন– গর্ভপাত, সমকামীতা, ট্র্যান্সজেন্ডার (লিঙ্গ পরিবর্তন), পাঠ্যসূচী, পর্নোগ্রাফি, বহুত্ববাদ, ইমিগ্রেইশান, বর্ণপরিচয়, লাইফস্টাইল ইত্যাদি।
এই ধরনের ইস্যুগুলো নিয়ে তর্কগুলোকে সাধারনত বিছিন্ন ইস্যু হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই ইস্যুগুলো আসলে একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই ইস্যুগুলো নিয়ে মানুষের তর্ক আর মতপার্থক্য অল্প কিছু যুক্তি আর পাল্টাযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না। বরং এখানে সংঘাতটা আসলে দুই ধরনের ওয়ার্ল্ডভিউ (worldview), দুই ধরনের জীবনপদ্ধতির মধ্যে। কাজেই এই ধরনের প্রতিটা ইস্যুতে চলা সামাজিক তর্কগুলো আসলে একটা লম্বা যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত ছোট ছোট লড়াই।
স্বাভাবিকভাবে মনে করা হয় সাংস্কৃতিক যুদ্ধে মার্কিন ডানপন্থীরা পরাজিত হয়েছে। লিবারেল-বাম মূল্যবোধগুলোই এখন অ্যামেরিকার আইন, মিডিয়া এবং শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মাত্র ৬০-৭০ বছরের মধ্যে গভীরভাবে ক্রিশ্চিয়ান সমাজ থেকে অ্যামেরিকা আজ এসে পড়েছে সমকামীতা আর ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনার কবলে। কাজেই ডানপন্থীর পরাজয় নিয়ে খুব একটা সন্দেহের সুযোগ পাওয়া যায় না।
তবে আমার মতে অ্যামেরিকার ডানপন্থীদের কিছু সফলতাও আছে। সাংস্কৃতিক যুদ্ধের অন্যতম প্রধান দুটি উদ্দেশ্য হল –
- ক) সমাজে বিভাজন এবং মেরুকরণ বাড়ানো
- খ) ‘কালচার’ বা ‘সভ্যতাগত পরিচয়’-কে রাজনীতির মূল প্রশ্ন ও মূল কেন্দ্র বানানো
সাধারণত কোন দেশ বা সমাজের ভেতর মূল রাজনৈতিক বিভাজন বা দ্বন্দ্ব তৈরি হয় শ্রেণী, বর্ণ, অর্থনীতি, ভৌগলিক পার্থক্য কিংবা বিভিন্ন সেক্যুলার মতবাদের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। Kulturkampf-এর উদ্দেশ্য ব্যাপক সামাজিক মেরুকরণের মাধ্যমে ‘সভ্যতাগত পরিচয়’কে সমাজের প্রধান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরিণত করা। যেখানে রাজনীতির মূল কেন্দ্র হবে বিশ্বাস, জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা নিয়ে মতপার্থক্য।
একদম সহজে বললে, সাংস্কৃতিক যুদ্ধের উদ্দেশ্য আকীদাহর ভিত্তিতে সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি করা। রাজনীতির আলোচনাকে অমুক দল বনাম তমুক দল থেকে সরিয়ে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্বে পরিনত করা। সফলভাবে চালানো সাংস্কৃতিক যুদ্ধ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার পলিসিগত পার্থক্যগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে দেয়। তার বদলে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হয়ে দাড়ায়,
কার আকীদাহ কোনটা?
সমাজে বিভাজন এবং মেরুকরণ বাড়ানো এবং ‘কালচার’ বা ‘সভ্যতাগত পরিচয়’-কে রাজনীতির মূল প্রশ্ন ও মূল কেন্দ্র বানানো—এ দুই দিক থেকেই মার্কিন ডানপন্থীদের সফলতা উপেক্ষা করা যায় না। উগ্র সেক্যুলার গ্লোবালিসমের দিকে ঝোঁকার ব্যাপারটা পুরো পশ্চিমা বিশ্বেই ঘটেছে। কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যে মাত্রায় হয়েছে, অ্যামেরিকাতে সেভাবে হয়নি। অ্যামেরিকাতে এখনো শক্তিশালী ডান রাজনীতি আছে। টি-পার্টি (Tea Party), মিলিশিয়া মুভমেন্ট (Militia Movement), অল্ট-রাইট আছে[1]। আছে ট্রাম্পের মতো নেতা। অ্যামেরিকার অর্ধেকের কাছাকাছি জনগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্রভাবে বাকি অর্ধেকের জন্য ঘৃণা আছে। সাংস্কৃতিক যুদ্ধে জিততে না পারলেও, মেরুকরণ এবং কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক বিভাজন তৈরিতে মার্কিন ডানপন্থীরা সফল। এটুকু তাই বলাই যায়।
সাংস্কৃতিক যুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনা বাংলাদেশের মুসলিমদের প্রাসঙ্গিক কেন?
কারণ এই ধরনের আদর্শিক দ্বন্দ্বের বেশ কিছু কৌশলগত সুবিধা আছে।
সম্পদ, অবকাঠামো, দক্ষ জনবল, নেটওয়ার্কিংসহ বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের সেক্যুলার-প্রগিতিশীল শ্রেনী এবং মুসলিমদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের মধ্যে আছে চরম ভারসাম্যহীনতা। সাংস্কৃতিক যুদ্ধ থেকে পাওয়া সুবিধা এই ভারসাম্যহীনতাকে কিছুটা হলেও কমিয়ে আনে। যেমন—
১। বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছোটখাটো কথা বলাও অনেকের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু সামাজিক ইস্যুতে অনেক শক্ত কথাও তুলনামূলক সহজে বলে ফেলা যায়। এই ধরনের বিষয়ে এখনো ঐভাবে কথা নিয়ন্ত্রন করা যায় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কথা ও কাজের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সুযোগ আছে।
২। গত দু-তিন বছরের বিভিন্ন ঘটনা থেকে বোঝা যায় অনলাইন অ্যাক্টিভিসম-এর একটা প্রভাব অফলাইনে আছে। সম্প্রীতি বাংলাদেশ, ১০ মিনিট স্কুল, সাকিবের কালী পূজা, আড়ং, পহেল বৈশাখের আয়োজন ফ্লপ করা, নবী (ﷺ) অবমাননার বিরুদ্ধে কলেজ-ইউনিভার্সিটির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলসহ বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। অনলাইন প্রচারণার কারণে অত্যন্ত জনপ্রিয় বেশ কিছু সেক্যুলার কালচারাল আইকনকে এসব ঘটনায় নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটতে হয়েছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুসলিমদের সেন্টিমেন্ট আমলে নিয়ে প্রচ্ছন্ন বা পরোক্ষভাবে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়েছে। পহেলা বৈশাখের মত রাষ্ট্রযন্ত্র সমর্থিত সাংস্কৃতিক ঈদ-ও ব্যর্থ হয়েছে।
লক্ষনীয় বিষয় হল, এর জন্য স্বতন্ত্র মিডিয়া কোম্পানি, পত্রিকা, টিভিচ্যানেল তৈরি করতে হয়নি। বিশাল সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কিংবা অনেক টাকাপয়সা লাগেনি। কাজগুলো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মত ‘লো-টেক’, ‘সাশ্রয়ী’ পদ্ধতি ব্যবহার করেই।
তার ওপর এই কাজগুলো নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নিয়ে হয়নি। সবাই নিজের মতো এলেমেলোভাবে করেছে। একই কাজ যদি একটু পরিকল্পনা করে, অল্প কিছু পুঁজি খাটিয়ে, সমন্বয় করে করা যায় তাহলে এর প্রভাব কেমন হতে পারে ভাবুন তো?
৩। বিভিন্ন ভাইরাল সামাজিক ইস্যু/ইভেন্ট; বিশেষ করে যেসব ইস্যুতে ইসলামী এবং সেক্যুলার মূল্যবোধের সংঘাত থাকে–সেগুলো সামাজিক মেরুকরণের এঞ্জিনের মত কাজ করে। অর্থাৎ এই ইস্যুগুলো নিয়ে তীব্র তর্ক-বিতর্ক সমাজের অনেকের চিন্তায় পরিবর্তন আনে। বিশেষ করে যারা আদর্শিক ভাবে সেক্যুলার না, আবার ‘প্র্যাকটিসিং মুসলিম’ও বলা চলে না – এই ধরনের মধ্যবর্তী মানুষের মধ্যে এসব তর্কের ফলে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যে মানুষ এর আগে কখনো এসব বিষয় নিয়ে ভাবেনি, সেও কিছুটা চিন্তা করতে বাধ্য হয়। সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কারণে যে সত্যগুলো মানুষ ভুলে ছিল সেগুলো আবার সে মনে করতে শুরু করে।
৪। পরিকল্পিতভাবে চালানো সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ফলে ধীরে ধীরে সমাজের প্রচলিত আলোচনা এবং বয়ানে পরিবর্তন আসে। কিছু কনসেপ্ট গ্রহণযোগ্যতা হারায়, কিছু নতুন কনসেপ্ট যুক্ত হয়। যে আলোচনাগুলোকে কালচাড়াল জমিদারর আগে অচ্ছুৎ বানিয়ে রেখেছিল, এই ধরনের মূহুর্তগুলোতে সেগুলোকে মাটি খুড়ে টেনে তুলে দাড় করিয়ে দেয়া যায় সবার সামনে। ধাক্কা দিয়ে বড় করে ফেলা যায় সমাজের গ্রহণযোগ্য আলোচনার সীমানাকে।
এখনও পর্যন্ত এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ শাহবাগ-শাপলা দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে ব্যাপক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন আগে পহেলা বৈশাখের (২০২২) ফ্লপ হবার পেছনেও এই ধরনের মেরুকরণের ভূমিকা আছে।
সাংস্কৃতিক যুদ্ধের আলোচনা থেকে নিচের পয়েন্টগুলোকে তাই মূল শিক্ষা হিসেবে নেয়া যায় –
ক) ভাইরাল/বিতর্কিত সামাজিক ইস্যুকে যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে মেরুকরণ বৃদ্ধি, এবং নিজের মতাদর্শের প্রসার ঘটানো সম্ভব।
খ) ‘কালচার’ বা ‘সভ্যতাগত পরিচয়’-কে রাজনৈতিক বিভাজনের মূল কেন্দ্র বানানো সম্ভব।
গ) অনলাইন অ্যাক্টিভিসমের মাধ্যমে ‘অল্প খরচে’/ফ্রী প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে স্বল্পমেয়াদী প্রভাব তৈরি করা সম্ভব।
ঘ) এভাবে সমাজের গ্রহণযোগ্য আলোচনার সীমানাকে বড় করা সম্ভব। পরিবর্তন আনা সম্ভব মানুষের চিন্তার জগতেও।
ঙ) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কথা বলা ও কাজের সুযোগ বর্তমানে অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সুযোগ আছে।
(এরকম আরো বিভিন্ন কৌশলগত সুবিধা দেখানো সম্ভব। তবে আমাদের আলোচনার জন্য আপাতত এটুকু যথেষ্ট)
এসব কারণে সেক্যুলারদের আধিপত্যকে ভাঙ্গার জন্য যেকোন রাজনৈতিক কৌশলের চেয়েও ‘কুলট্যুরকাম্ফ’/সাংস্কৃতিক যুদ্ধ—সভ্যতা ও আকীদাহগত পরিচয়ের ভিত্তিতে লড়াইয়ের এই পদ্ধতি তাই প্রাধান্য পাবার দাবি রাখে।
[1] উগ্র ডানপন্থী এবং নব্যনাৎসি বিভিন্ন গোষ্ঠী