পর্ব ৭
লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে
মেটাপলিটিকস-এর ধারণার উৎপত্তি উনবিংশ শতাব্দীর জার্মান চিন্তাবিদদের মধ্যে। প্রাথমিকভাবে মেটাপলিটিকস বলতে বোঝানো হতো অধিকার এবং রাজনীতির ব্যাপারে দার্শনিক অনুসন্ধানকে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জার্মানদের কাছ থেকে মেটাপলিটিকসের ধারণা গ্রহণ করে ফরাসী চিন্তাবিদরা। গ্রহণের পাশাপাশি ফরাসী কিছু সংযোজনও করে। তাদের সংজ্ঞায়নে মেটাপলিটিকস হয়ে দাড়ায় সামগ্রিকভাবে রাজনীতির ব্যাপারে দার্শনিক অনুসন্ধান।
মেটা-পলিটিকস অর্থ রাজনীতি করা না, বরং রাজনীতির ব্যাপারে চিন্তা করা। রাজনৈতিক অবস্থানের ধর্মীয়, এবং বিশ্বাসগত শেকড় অনুসন্ধান করা।
তবে সময়ের সাথে মেটাপলিটিকসের ধারণায় পরিবর্তন এসেছে বারবার। বিভিন্ন ঘরানার বুদ্ধিজীবি এবং রাজনৈতিক চিন্তকরা একে ব্যাখ্যা করেছে বিভিন্নভাবে। বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক অ্যালেইন বাদিও যেমন ২০১২ সালে প্রকাশিত তার মেটাপলিটিকস নামের বইতে রাজনীতির মেটাপলিটিকাল আলোচনা উপস্থাপন করেন মার্ক্সিস্ট, লেনিনিস্ট এবং মাওয়িস্ট বৈপ্লবিক দর্শনের জায়গা থেকে।
তবে আমরা মেটাপলিটিকসের একটি নির্দিষ্ট ধারণার দিকে তাকাবো। এই ধারণা গড়ে করার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ১৯৬০ এর দশকের ফরাসী কিছু ডানপন্থী চিন্তকের। নব্য ডানপন্থী এই ফরাসী চিন্তাবিদরা ইটালিয়ান নিও-মার্ক্সিস্ট অ্যান্টনিও গ্র্যামশির ‘কালচারাল হেজেমনি’র ধারণা গ্রহণ করেন। গ্র্যামশির তত্ত্বের একটা অনুসিদ্ধান্তও তারা গ্রহণ করেন –
‘রাজনৈতিক বিজয়ের পূর্বশর্ত আদর্শিক আধিপত্য (হেজেমনি) অর্জন’
এই তত্ত্ব ও অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তারা উপসংহার টানেন–
রাজনৈতিক বিপ্লবের শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব থেকে। আর এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের মূল ময়দান হল সংস্কৃতি। মানুষ কীভাবে চিন্তা করে, এটা যখন বদলে যায়, তখন অবধারিতভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে।
মেটাপলিটিকস হল এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আনার প্রচেষ্টা।
ফরাসী নব্য ডানপন্থীদের প্রধান তাত্ত্বিক ধরা হয় অ্যালেইন ডি বেনওয়াকে। ডি বেনওয়ার মতে–
‘পৃথিবীর সব বড় বড় বিপ্লবগুলো আসলে কী করেছে? চিন্তার জগতে ইতিমধ্যে যে বিবর্তন হয়ে গেছে, বিপ্লবগুলো কেবল সেটাকে বাস্তবায়ন করেছে।’
মেটাপলিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বদলে প্রাধান্য দেয় সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে। আর এখানেই গত শতাব্দীর প্রথম ভাগের ইউরোপীয় ডানপন্থী, রক্ষনশীল এবং অ্যামেরিকার নব্য-রক্ষণশীল ইত্যাদি ধারার সাথে ‘নব্য ডানপন্থী’দের মূল পার্থক্য।
ডি বেনওয়াদের মতে, মেটাপলিটিকাল কর্মসূচী গতানুগতিক রাজনৈতিক কিংবা সশস্ত্র পন্থার মতো না। কারণ অর্থবহ রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে হলে আগে শিক্ষা, মিডিয়া এবং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
ফরাসী নব্য ডানপন্থীদের হাত ঘুরে আসা মেটাপলিটিকসের এই ধারণাকে নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকে লুফে নেয় অ্যামেরিকার অলট-রাইট (Alt Right/Dissident right), এবং গত ১৫ বছরে ইউরোপে মাথাচাড়া দেয়া ‘আইডেন্টিটারিয়ান’ আন্দোলনগুলো।
তাদের চোখে মেটাপলিটিকস হল ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন আনার চাবিকাঠি। মেটাপলিটিকাল যুদ্ধ এমন এক ময়দানে, এমন এক অক্ষে ঘটে, ব্যাপক মিডিয়া এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তা সত্ত্বেও বামপন্থী এবং লিবারেলরা যেখানে দুর্বল।
অলট-রাইট এবং আইডেন্টিটারিয়ানদের উদ্দেশ্য হল মেটাপলিটিকসের মাধ্যমে ইউরোপ ও অ্যামেরিকার শ্বেতাঙ্গদের এক এক করে তাদের দলে নিয়ে আসা। তারা মনে করে পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থা বর্তমান অবক্ষয় এই মেটাপলিটিকাল পরিবর্তনকে আরো দ্রুত করে তুলবে।
অ্যামেরিকান অলট-রাইট এবং ইউরোপীয় আইডেন্টিটারিয়ানদের ভাষ্যমতে তাদের মেটাপলিটিকসের উদ্দেশ্য হল–
- কোন কোন রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক,
- কোন কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য কাঙ্ক্ষিত, এবং
- কোন কোন রাজনৈতিক ফলাফল অর্জন করা সম্ভব
–এ ব্যাপারে মানুষের চিন্তাকে বদলে দেয়া।
সহজ ভাষায়, সমাজের মানুষের চিন্তায় ‘গ্রহণযোগ্য রাজনীতি’-এর যে ধারণা আছে, সেটাকে প্রশস্থ করা। মানুষের চিন্তার সীমানাকে নিজেদের আদর্শের দিকে টেনে আনা। মানুষের চিন্তার কাঠামো আর ওয়ার্ল্ডভিউ পালটে দেয়া। বিপ্লবের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে সাংস্কৃতিক অঙ্গন, বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন এবং জনপরিসরকে প্রভাবিত করা।
তারা মনে করে-
বর্তমান ব্যবস্থা যেহেতু টিকে আছে কালচারাল হেজেমনির মাধ্যমে, তাই সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মাধ্যমে; মেটাপলিটিকাল স্ট্রাগলের মাধ্যমে, বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনও সম্ভব।
মানুষের চিন্তার ধরণ পাল্টে দেয়ার এই কাজটা কোন নির্দিষ্ট দল বা সংগঠনের দ্বারা হওয়া জরুরী না। বরং বিভিন্ন দিক থেকে বিকেন্দ্রীকৃত ভাবেও কাজটা হতে পারে। তবে আলাদা আলাদা জায়গা থেকে কাজ করলেও পলিসি, স্ট্র্যাটিজি, মৌলিক বার্তার মতো কিছু ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য থাকবে। এবং সবার মৌলিক উদ্দেশ্য হবে এক:
- বিদ্যমান সামাজিক আধিপত্যকে (কালচারাল হেজেমনিকে) নষ্ট করা
- নিজেরা সামাজিক আধিপত্য অর্জন করা
- বিপ্লব