পর্ব ৯
লেখাটি “What Is To Be Done: ইসলামবিদ্বেষ, উগ্র-সেক্যুলারিসম এবং বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের ভবিষ্যৎ” সিরিযের অংশ। আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে, সবগুলো পর্বের লিঙ্ক একসাথে এখানে
মেটাপলিটিকস কী—সেটা আমরা মোটামুটি জানলাম। কিন্তু আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় মেটাপলিটিকাল লড়াই হবে কিভাবে?
এ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর খুজতে হলে আমাদের তাকাতে হবে অ্যামেরিকার অলট-রাইট এবং ইউরোপের আইডেন্টিটারিয়ানদের গ্রহণ করা মেটাপলিটিকাল কৌশলগুলোর দিকে। তাদের উদাহরণ নানা কারণে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক।
- আলোচনার শুরুতে আমরা বলেছিলাম—সম্পদ, অবকাঠামো, জনবল, নেটওয়ার্কিংসহ বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের এলিট সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী এবং মুসলিমদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যের মধ্যে কোন ধরণের ভারসাম্য নেই।
এবং,
- সেক্যুলার-প্রগতিশীল এলিটরা বাংলাদেশে সামাজিক আধিপত্যের একটি কাঠামো তৈরি করেছে। যে কাঠামোর ফলে অনুমোদিত সীমার বাইরে ইসলামী যেকোন ধারণা ও সেন্টিমেন্ট প্রকাশ, প্রচার করা, এবং এর ভিত্তিতে দাবি জানানো সামাজিকভাবে অত্যন্ত কঠিন।
বাংলাদেশের মুসলিমদের যেকোন সামাজিক-রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হল ওপরের এই দুটি বিষয় । এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর কারণে জনপরিসরে আমরা খোলাখুলিভাবে ইসলামের কথা বলতে পারি না। আমাদের মুসলিম পরিচয় এবং ওয়ার্ল্ডভিউ নিয়ে আলোচনায় হাজির হতে পারি না। ইসলামের কথা বলতে হলেও সেটাকে আনতে হয় বিদ্যমান হেজেমনিক ডিসকোর্সের ছাঁচে ফেলে। অর্থাৎ সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের তৈরি করা ছকে, তাদের ভাষা ও তাদের তৈরি নানা ধারণা ব্যবহার করে। আর এতে করে সাংস্কৃতিক জমিদারদের আধিপত্য এবং বিদ্যমান কাঠামো আরো বেশি শক্তিশালী হয়, বৈধতা পায়। জনপরিসরে কার্যত আমাদের হাত-পা-মুখ সবই বাঁধা।
এই প্রতিবন্ধকতা পাড় হবার উপায় কী? আমাদের হাতে মিডিয়া নেই, প্ল্যাটফর্ম নেই, সক্রিয় কোন পাবলিক সংগঠন নেই, সামাজিক ভয়েস নেই, অর্থ নেই, লোকবল নেই। করণীয় কী?
এখানেই অ্যামেরিকার অলট-রাইট এবং ইউরোপের আইডেন্টিটারিয়ানদের প্রাসঙ্গিকতা। শত্রুর সাথে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং সামর্থ্যের স্বল্পতার দিক থেকে সহস্রাব্দের শুরুর দিকে (এবং এখনও) তাদের অবস্থা ছিল অনেকটা আমাদের মতোই। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাদেরকে ঐভাবেই সেন্সরশিপের মুখোমুখি হতে হয়েছে, যেভাবে আমাদের হতে হয়। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অলট-রাইট এবং আইডেন্টিটারিয়ানরা গত ৬-৭ বছরে ইউরোপ-অ্যামেরিকার সামাজিক আলোচনার সীমানায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পেরেছে।
যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইউরোপের রাজনীতির কেন্দ্র ডানদিকে সরে যাওয়া এবং অ্যামেরিকার সমাজ ও রাজনীতির ব্যাপক মেরুকরণ। এর পেছনে নিঃসন্দেহে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, অভিবাসন, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধের’ প্রভাব, দুর্যোগ, সামাজিক অবক্ষয়সহ বিভিন্ন ফ্যাক্টরের ভূমিকা আছে। তবে এটাও সত্য যে অলট-রাইট এবং আইডেন্টিটারিয়ানরা এখানে সক্রিয় একটি ভূমিকা রেখেছে। তাই তাদের উদাহরণ থেকে শেখার মতো আছে অনেক কিছুই।
এই নব্য ডানপন্থীরা মেটাপলিটিকসকে দেখে গেরিলা যুদ্ধের মতো করে।
গেরিলা যুদ্ধ হল সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলের যুদ্ধ। প্রবল শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে অল্প সামর্থ্য নিয়ে ঘায়েল করার কৌশল। নব্য ডানপন্থীদের কাছে মেটাপলিটিকস হল আদর্শিক গেরিলা যুদ্ধ। তারা এই যুদ্ধের প্রকল্প শুরু করে একটা মেটাপলিটিকাল ভ্যানগার্ডের (vanguard: অগ্রবর্তী দল, طليعة) ধারণা থেকে। এমন এক অগ্রবর্তী দল, যারা এই আদর্শিক সংগ্রামের মূল ধারণা এবং মোটিফগুলো ধীরে ধীরে জনপ্রিয় করে তুলবে। এই ভ্যানগার্ডের লেখনী, বক্তব্য, আলোচনার মাধ্যমে এ চিন্তায় দীক্ষিত হবে নতুন নতুন মানুষ। ধীরে ধীরে এই সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়বে অনেকটা বিকেন্দ্রীভূতভাবে।
মিডিয়া, অর্থ, লোকবল নিয়ে সীমাবদ্ধতাগুলো আমলে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে সামনে রেখে তারা কর্মপরিকল্পনা সাজায়। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, এবং পডক্যাস্টিং এর বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম। পাশাপাশি কাজে লাগানো হয় ৪-চ্যান, ৮-চ্যান এবং রেডিটের মতো বিভিন্ন অনলাইন ফোরামকে। ভাইরাল বিভিন্ন কালচারাল ইস্যুর পাশাপাশি ফোকাস করা হয় বর্ণপরিচয় (race) এর মতো ডানপন্থার মৌলিক কিছু ধারণাকে। আদর্শিক যুদ্ধের কৌশল হিসেবে অভিনবভাবে কাজে লাগানো হয় Trolling এবং Meme-ing।
এই আদর্শিক গেরিলা যুদ্ধে নব্য-ডানপন্থীরা বিভিন্ন ধরণের কৌশল ব্যবহার করে। একদিকে তাত্ত্বিক আলোচনা, অন্যদিকে ট্রোলিং, এবং মিম। একদিকে লিবারেল ডিসকোর্সের খন্ডন এবং মডার্নিটিকে আক্রমন করা, অন্যদিকে বিভিন্ন নেতিবাচক ট্যাগ ব্যবহার জনপ্রিয় করে জনপরিসরের আলোচনাকে শর্টসার্কিট করা। পাশাপাশি তারা অফলাইন কিছু পাবলিক ইভেন্টের কর্মসূচীও গ্রহণ করে। এভাবে ধীরে ধীরে অলট-রাইট তাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে শুরু করে।
পাশ্চাত্যের নব্য ডানপন্থীদের সব কৌশল অনুসরণ করার মতো না। আদর্শিকভাবে তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য অনতিক্রম্য। এদের অনেকেই নিরেট নাৎসি আদর্শ ধারণ করে। তাছাড়া মেটাপলিটিকাল কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাদের বেশ কিছু ভুল আর মিসক্যালকুলেশন আছে। তাসত্ত্বেও তাদের আন্দোলন থেকে শেখার, গ্রহণ করার এবং কাজে লাগানোর মতো বেশ কিছু বিষয় পাওয়া যায়। তবে নিও-মার্ক্সিস্ট কিংবা নিও-নাৎসি—যাদের কাছ থেকেই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা হতে হবে শরীয়াহর ছাকনিতে মেপে, এবং দ্বীন ইসলামের সাথে আপোস না করে।