ছেলেটির সাথে দেখা হল মেয়েটির। প্রথমে একটু কৌতুহল। সাধারণের চাইতে একটু বেশি সময় তাকিয়ে থাকা হয়তো। পাশ দিয়ে যাবার সময় হাটার গতি একটু ধীর করা। তারপর ভালোলাগা। একটা নির্দিষ্ট কন্ঠ শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখা। ‘তার’ আশেপাশে কথা বলার সময় একটু অন্যভাবে, অন্য ভঙ্গিতে বলা। চিন্তার জগতে আনাগোনা বেড়ে যাওয়া। তারপর ভালোবাসা, কাছে আসা হল.. ঘুরে ফিরে সেই একই গল্প। গল্পের খুঁটিনাটি বদলায় কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই একই মেসেজ। সব দিক থেকে, সব জায়গা থেকে উচ্চ স্বরে, একসাথে উচ্চারিত হচ্ছে একই মন্ত্র।
আমরা এমন এক কালচারের মধ্যে বসবাস করছি যা ছোটবেলা থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে মানব অস্তিত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রেম খুজে ফেরা, প্রেমের খোঁজ করা, প্রেমের মাঝে জীবনের উদ্দেশ্য খুজে পাওয়া, প্রেমকে জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়ে নেওয়া, প্রেমের জন্য জীবন দেওয়া, প্রেমের জন্য মারামারি করা এন্ড সো অন। গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, নাটক, টিভি সিরিয়াল, মিউযিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন পত্রিকার পাতা, বিলবোর্ড – সব গুলো মাধ্যম থেকে প্রচারিত হচ্ছে একই গল্পের নানা ভেরিয়েশান।
আমরা এমন একটা অদ্ভূত সময়ে বসবাস করছি যখন মিডিয়া ও কালচার সম্পূর্ণ ভাবে যিনাসেন্ট্রিক। আর ভয়ংকর ব্যাপারটা হল এটা শুধুমাত্র যিনাকেন্দ্রিকতায় সীমাবদ্ধ না। বরং মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যিনাকে মহিমান্বিত করায় ব্যস্ত। রোনালদো কিংবা মেসির মতো “আইকন” অবৈধ সন্তানদের খবর শোভা পায় প্রতিদিনের পত্রিকায়। মেসি বা রোনালদোর মত হতে চাওয়া ছেলেতার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়াটা, নিজ সন্তানের গর্ভধারীনীকে বিয়ে না করাটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
প্রথম আলোর পাতাতে কিশোর-কিশোরীদের শেখানো হয় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে কোন সমস্যা নেই, এটিই প্রকৃতির নিয়ম। নকশা আর অধুনা ফিচার করে শেখানো হচ্ছে কিভাবে সুন্দরভাবে নতুন বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ডের কাছে সাবেক বয়/গার্লফ্রেন্ডের কথা বলা যায়। ভ্যালেন্টাইন উপলক্ষে বিশেষ প্রতিযোগিতা করে সবক দেয়া হয় ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’-এর সাথে ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের’ শেখানো হয় কিভাবে মধ্যযুগীয় রক্ষনশীলতা থেকে বের হয়ে আধুনিক হওয়া যায়। কিভাবে নতুন ব্র্যান্ডের সেলফোনের মত, বার বার নিজের শরীর আর মনের জন্য নতুন নতুন প্রেম খুজে নেওয়া যায়।
এভাবেই এক সময় এটাই প্রচলিত হয়ে যায়। রাস্তায়, রিকশায়, পার্কে, বাসে উপচে পড়া প্রেমের ভিড়ে চলাফেরাটা একসময় কঠিন হয়ে দ্বারায়। একুশে থেকে পহেলা বৈশাখ, শোক দিবস থেকে বিজয় দিবস সব ছুটির দিন একসময় ভ্যালেন্টাইনে পরিনত হয়। হাইস্কুলের ছাত্র থেকে চল্লিশ ঘরে পা দেওয়া বিবাহিত মানুষগুলো পর্যন্ত সবাই হন্যে হয়ে খুজে বেড়ায় ঐ প্রেমকে যা তাদের জীবনকে অর্থ এনে দেবে, কিংবা এনে দেবে ক্ষণিকের সুখ।
এটাই এখন নরমাল। এটাই রীতি। সমাজ ও মিডিয়ার ক্রমপরিবর্তনশীল আপেক্ষিক নৈতিকতা অনুযায়ী যা একসময় ছিল অগ্রহনযোগ্য তাই সর্বসম্মতিক্রমে নিয়মে পরিণত হয়। যা ছিল অপমানের, লজ্জার, লুকিয়ে রাখার, তা এখন গর্ব, মর্যাদার ও ঘোষণা করার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আর তাই কিংবা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন আসমান ও যমীনের মালিকের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে মানুষ জোর গলায় বলে- প্রেমই তো করছি কোন অপরাধ তো করছি না।
কিংবা কেউ হয়তো বলেন – আমরা সত্যিসত্যি একে অপরকে ভালোবাসি – আর সত্যি ভালোবাসার জন্য আলাদা কোন নিয়ম আছে নাকি সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তায় ফেলে দেয়। কিংবা শুনতে পাওয়া যায় – “আমরা তো ‘ঐ কাজটা” করছি না, কেন শুধুশুধু সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে এতো শোরগোল করছেন?”
কিন্তু সমাজের তৈরি করা আপেক্ষিক নৈতিকতা কিংবা নিজ অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেয়ার সময় আমরা কি চিরন্তন, শ্বাশত নৈতিকতার কথা চিন্তা করি? আমরা কি সেই সত্ত্বার কথা চিন্তা করি যার কাছে অনু-পরমাণু কাজের হিসেব দিতে হবে? যার কাছে “বাকি সবাই করেছিলো তাই আমিও করেছি” – এই যুক্তি দিয়ে পার পাওয়া যাবে না? যার কাছে মিথ্যা বলা যাবে না? যার সামনে যুক্তির পসরা সাজিয়ে বসা যাবে না?
হে সেজেগুজে নিজেকে নষ্ট করতে প্রস্তুত মানুষ, আসমান ও যমীনের মালিকের কথাগুলো শুনে যাও। সস্তা, সাময়িক সুখের জন্য অনুশোচনার সেই দিনে তাঁর সামনে হিসেব দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছো কি না নিজেকে প্রশ্ন করো –
‘আর তোমরা যিনা-ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ [তরজমা, সূরা আল ইসরা, ৩২]
13/02/2020, 18:43