“দেশে দেশে কাফিরদের সদম্ভ পদচারণা তোমাকে যেন বিভ্রান্ত না করে। সামান্য ভোগ, তারপর জাহান্নাম তাদের আবাস, আর তা কতই না নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল!”
সম্প্রতি অ্যামেরিকা-বেইসড ইয়াক্বিন ইন্সটিটিউট অফ ইসলামিক রিসার্চ – Yaqeen Institute Of Islamic Research (উমার সুলাইমান, জনাথন ব্রাউন) কোন কোন ফ্যাক্টরগুলোর কারণে অ্যামেরিকান মুসলিমরা ইসলামের ব্যাপারে সংশয়ে পরে যান তা নিয়ে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। What Causes Muslims To Doubt Islam : A Quantitative Analysis নামের ২৪ পেইজে একটি রিপোর্টে জরিপের ফলাফলগুলো তুলে ধরেছেন ইউসুফ শুহুদ। ২০১৬ সালে একই লেখক Modern Pathways To Doubt In Islam নামে একই ধরণের আরেকটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেন। দুটো লেখার শিরোনামে Doubt বা সংশয় শব্দটি ব্যবহার করা হলেও, এখানে Doubt শব্দের দ্বারা উদ্দেশ্য হল রিদ্দা বা Apostasy (ধর্মত্যাগ).
লেখা দুটো থেকে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং প্যাটার্ন এবং উপসংহার পাওয়া যায়, যেগুলো পশ্চিমা মুসলিমদের পাশাপাশি আমাদের সমাজের অনেকের সংশয়ের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। একইসাথে পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমানে যে ধরণের “ইসলাম” প্রচার করা হয়, এবং বর্তমানে যা বাংলাদেশেও চলছে, সেই “মডারেট সিভিল ডেমোক্রেটিক ইসলাম” কেন সার্বিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে এ ধরণের সংশয়ের মোকাবেলায় ব্যর্থ হবে সেটা বোঝার জন্যও ইন শা আল্লাহ এ জরিপ থেকে উঠে আসা কিছু তথ্যের বিশ্লেষণ কার্যকরী হবে।
সংশয়ের উৎস?
কোন কোন কারণে অ্যামেরিকান মুসলিমরা ইসলামের ব্যাপারে সংশয়ে পরে যান? কোন বিষয়গুলো তাদের সংশয়ের উৎস কিংবা ট্রিগার হিসেবে কাজ করে? ৬০০ জনের ওপর চালানো জরিপে ১৩টি কারনের কথা উঠে এসেছে।
১) ইসলাম পালন করার একটাই মাত্র সঠিক পদ্ধতি আছে অনেকের এমন দাবি – ৬৪%
(এখানে ফিকহি মতপার্থক্যের কথা বলা হচ্ছে না। পরে বিষয়টি ইন শা আল্লাহ আরো পরিস্কার হবে)
২) ধর্মের নামে অনেক মানুষ যেসব অন্যায় করে – ৬৩%
৩) অন্যান্য ধর্মের প্রতি অনেক ধার্মিক মুসলিমদের অসহিষ্ণুতা – ৬১%
(অর্থাৎ জরিপে অংশগ্রহণ করা ৬১% এর মতে আল ওয়ালা ওয়াল বারা, ইসলাম নিয়ে সংশয় ও রিদ্দার কারণ)
৪) আপাতভাবে ধার্মিক এমন ব্যক্তিদের অনৈসলামি কার্যকলাপ – ৬১%
৫) The Problem Of Evil – ৫৮%
(The Problem Of Evil: “আল্লাহ যদি পরম করুণাময় হন, কল্যাণময় হন, ন্যায়বিচারক হন তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ-দুর্দশা কেন? কেন এতো নিরীহ মানুষ এতো নির্যাতন, কষ্টের মধ্যে দিয়ে যায়?” )
৬) কিছু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি অসহিষ্ণুতা (যেমন সমকামিদের প্রতি) – ৫৮%
৭) কিছু বিশ্বাস ও ইবাদত যৌক্তিক না মনে হওয়া, অর্থহীন মনে হওয়া – ৫৭%
৮) নারীর ভূমিকার ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা – ৫৫%
৯) প্রিয়জনের মৃত্যু – ৪৯%
১০) বিবর্তনবাদ নিয়ে বিতর্ক – ৫৩%
১১) আবিস্কার করা যে ধর্ম পালন করে সুখ (happiness) পাওয়া যায় না – ৪৪%
১২) অন্যান্য মুসলিমদের মাঝে নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হওয়া – ৪২%
১৩) স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ – ৩৮%
এছাড়া ফলোআপ প্রশ্নের ভিত্তিতে দ্বিতীয় আরেকটি টেবিল করা হয়েছে, যেখানে আগের ফলাফলগুলোই একটু ভিন্ন ক্রমধারায় এসেছে।
এখানে যেসব কারণ উঠে এসেছে সেগুলোকে মোটামুটি তিনভাবে ভাগ করা যায়।
- দর্শন ও বিজ্ঞান
- নৈতিকতাসংক্রান্ত ও সামাজিক বিষয়
- ব্যক্তিগত
দর্শন ও বিজ্ঞান
দেখা যাচ্ছে, আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে সবচেয়ে বেশি আলোচিত দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর বদলে, নৈতিকতাসংক্রান্ত ও সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে বেশি সংশয় তৈরি হচ্ছে। উল্লেখিত ১৩টি উৎসের মধ্যে ১০ ও ১৩ নম্বরে বিবর্তনবাদ ও স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়ের কথা এসেছে। ৭ নম্বরে এসেছে কিছু বিশ্বাস ও ইবাদত “অর্থহীন” মনে হবার বিষয়টি। তবে এই “অর্থহীন” মনে হবার ব্যাপারটি পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞানসংশিষ্ট বিষয়গুলোর সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয় না। ৫ নম্বরে এসেছে Problem of Evil এর কথা। সুতরাং নাস্তিকরা যেগুলোকে তাদের সবচেয়ে জোরালো যুক্তি মনে করছে, সেগুলো আসলে ততোটা কার্যকরী না। “কুরআনের অমুক আয়াত অবৈজ্ঞানিক, বুখারির এতো নাম্বার হাদিসের কথা সঠিক না” – নাস্তিকদের এ ধরনের কথাবার্তা, এই জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, মুসলিমদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর না।
নৈতিকতাসংক্রান্ত ও সামাজিক বিষয়
অন্যদিকে, নৈতিকতাসংক্রান্ত ও সামাজিক এমন কিছু ইস্যুতে মুসলিমদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে যা অবাক করার মতো। এই ইস্যুগুলো কেমন?
Modern Pathways To Doubt থেকে কিছু উদাহরণ দেখা যাক –
- ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী নারীর ভূমিকা – একজন মা তার ছেলে ও মেয়ে সন্তানদের সাথে একইরকম আচরণ করতেন না। বড় ভাই যা ইচ্ছে করতে পারতো মা কিছুই বলত না,কিন্তু ছোট বোনের জন্য ছিল অনেক নিষেধ, অনেক মানা, অনেক নিয়মনীতি…একারনে পরবর্তীতে সেই মহিলার মনে ইসলাম নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে সে ইসলাম ত্যাগ করে সংশয়বাদী (Agnostic) হয়ে যায়।
- যিনা – অ্যামেরিকার ডেইটিং কালচার এবং বিয়ের আগে যৌনতার ব্যাপারে অ্যামেরিকার সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক মুসলিম হতাশায় ভুগতে থাকে। কারণ ইসলাম বিয়ের আগে যৌনতা এবং নারীপুরুষের সম্পর্কের বৈধতা দেয় না। মানসিক যাতনা কাটাতে আবির্ভাব ঘটে সংশয়ের। যারা ডেইট করে, যারা বিয়ের আগে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছে বা হচ্ছে, ইসলামকে সত্য হিসেবে মেনে নেয়া তাদের জন্য তেমন একটা লাভজনক না। তারা চায় ইসলাম সত্য না হোক, কারণ তাহলে আর নিজেরদেরকে নিয়ে অনুতপ্ত হতে হবে না।
- সমকামিতা – নিজেকে মুসলিম দাবি করা কিন্তু ইসলাম নিয়ে বড় ধরণের সংশয়ে ভোগা (!) একজন নারীর জন্য সমস্যাটা হল সমকামিতার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। “‘যাদের জন্মই হয়েছে’ সমকামি হিসেবে কীভাবে আল্লাহ তাদের জন্য এমন নিয়ম ঠিক করে দেন যাতে করে তাদের সামনে কেবল দুটো পথ খোলা থাকে, সারা জীবন নিজের যৌনকামনাকে চেপে রাখা, অথবা ইসলাম ত্যাগ করা”- মহিলার প্রশ্ন। এই মহিলা সমকামিতার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান তার নিজের “অন্তর্নিহিত নৈতিকতা আর ইনসাফের” ধারণার সাথে মেলাতে পারেন না।
- আ’ইশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা – অ্যামেরিকান মুসলিমদের অনেকেই আ’ইশার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সাথে রাসূলুল্লাহর ﷺ বিয়েকে প্রবলেম্যাটিক মনে করে। ইসলামবিদ্বেষীদের প্রিয় এ টপিক অ্যামেরিকান মুসলিমদের অনেকের মনেই সংশয় তৈরি করে।
- জিহাদ – সন্ত্রাসবাদ নিয়ে চালানো মিডিয়া প্রপাগ্যান্ডা, এবং লিবারেলিযম ও সেক্যুলার হিউম্যানিযমের চশমা দিয়ে ইসলামের ইতিহাসকে দেখলে অনেক মুসলিমই সংশয়ে পরে যায়, “ইসলাম কি আসলেই অসহিষ্ণু?” ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তারা যখন দেখে জিহাদ সবসময় ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, তাদের সংশয় আরো বেড়ে যায়। “ইসলাম শান্তির ধর্ম”, এ মুখস্থ জবাবে তখন আর কাজ হয় না।
- ইসলাম পালন করার সঠিক পদ্ধতি একটাই – জরিপ অনুযায়ী ইসলাম নিয়ে সংশয় সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হল, ‘ইসলাম পালনের সঠিক পদ্ধতি একটাই’, অনেক মুসলিমের এমন দাবি। আমরা জানি যে, ফিকহি বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য জায়েজ, এবং এটা ইসলামের একটা সৌন্দর্য। সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলাম পালনের সঠিক পদ্ধতি একটাই, এমন বলা ভুল। নামাযে হাত রাখার জায়গা কেবল একটাই, জামাত নামায পড়ার সময় সূরা ফাতিহার পর আমীন বলার ব্যাপারে সঠিক অবস্থান একটাই, এমন বলা হলে সেটা অবশ্যই ভুল। কিন্তু একটু আগে যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে, যেমন ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী নারীর অবস্থান, যিনা, সমকামিতা ইত্যাদি বিষয়ে, ইসলামের অপরিবর্তিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে একথা সম্পূর্ণ সঠিক যে ইসলাম পালনের সঠিক পদ্ধতি একটাই। আলোচ্য জরিপে এ দ্বিতীয় অর্থটাই এসেছে। জরিপে অংশগ্রহনকারীদের সামনে যেসব প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয়েছিল সেগুলো দেখলে বোঝা যায়, এখানে ফিকহি মতপার্থক্যকে বোঝানো হচ্ছে না। যেমন –
- “বিয়ে আর জানাযা বাদ দিলে আমি কতোটা নিয়মিত মসজিদে যান?”
- “সাধারণত আপনি কতোটা নিয়মিত নামায পড়েন?”
- – “কুরআনের ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন –
ক) কুরআন আল্লাহর কালাম, এবং একে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে?
খ) কুরআন আল্লাহর কালাম কিন্তু এতে এমন অনেক কিছু আছে যা কেবল রূপক
গ) কুরআন মানুষের লেখা ইতিহাস ও নৈতিকতা সংক্রান্ত একটি প্রাচীন বই”
- “নিচের কথাগুলোর ব্যাপারে আপনার মত কী?
– পৃথিবীতে দু ধরণের মানুষ আছে। একদল সত্যের পক্ষে আরেকদল সত্যের বিপক্ষে
– সমকামি যৌনসম্পর্ক ও বিয়ে
– সুদি ব্যাংক লোন
– অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব পালন করা
– অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করা
– মাথা না ঢেকে নারীদের বাইরে যাওয়া
– নারী ও পুরুষ মুসল্লিদের জন্য নারী ইমাম
– গর্ভের সন্তানের কারণে মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই, এমন ক্ষেত্রে গর্ভপাত”
সহজেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে নিছক মাসআলা-মাসায়েলগত মতপার্থক্যের সাথে সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন উপস্থাপন করা হচ্ছে না। এমনসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে যেগুলোর ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান পরিস্কার। যেগুলো স্পষ্ট হারাম এবং অনেক সময় কুফরের সাথে সম্পর্কিত। সমকামিতা, ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী নারীর ভূমিকা, হিজাব, নারী ও পুরুষ মুসল্লিদের জন্য, নারী ইমাম হতে পারবে কি না, যিনা (বিয়ের আগে যৌনতা), রাসূলুল্লাহর ﷺ বিয়ে, আল্লাহর হুকুম ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামেরর “ট্র্যাডিশানাল অবস্থান” (পড়ুন কুরআন ও সুন্নাহর অবস্থান, সালাফ আস-সালেহিনের অবস্থান, সঠিক অবস্থান) অ্যামেরিকান মুসলিমরা মেনে নিতে পারছে না। খোদ ইসলাম তাদের জন্য ইসলাম নিয়ে সংশয়ের উৎস হয়ে দাড়াচ্ছে। ইসলামের নৈতিকতা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। তারা এতোটাই “নৈতিক” হয়ে গেছে, এসব ক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান তাদের কাছে যথেষ্ট “নৈতিক” মনে হচ্ছে না।
সহজ ভাষায় দীর্ঘসময় ধরে পশ্চিমা নৈতিকতা ও দর্শন (সেক্যুলারযিম ও লিবারেলিযম) দ্বারা চালিত সমাজের মধ্যে থাকার কারণে, এবং এ পশ্চিমা ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ না করার কারণে পশ্চিমা নৈতিকতাকেই এরা নিজেদের কম্পাস হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। যখন ইসলামের অবস্থান এই পশ্চিমা কাঠামোর সাথে মিলছে না, তখন তারা ইসলাম নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাচ্ছে। তারা এমন এক ইসলাম চাচ্ছে যেটা পশ্চিমা কাঠামোর সাথে খাপ খায়। যখন ইসলামের কোন বিধান এই পশ্চিমা নৈতিকতার সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে, তখন তারা নতুনভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। আর যখন কেউ বলছে, “না ইসলামে সমকামিতা হারাম, সুদ হারাম, হিজাব ফরয, রাসূলুল্লাহর ﷺ অবমাননাকারীর শাস্তি মৃত্যু, জিহাদ ক্বিয়ামত পর্যন্ত ইসলামেরর ফরয বিধান, কেবল এককালীন না” – তখন সেটা তাদের জন্য “সংশয়ের উৎস” হয়ে যাচ্ছে। তারা ইসলাম ত্যাগ করছে।
ব্যক্তিগত
এছাড়া সংশয়ের উৎস হিসেবে ব্যক্তিগত শোকের কথাও জরিপে এসেছে। প্রিয়জনের মৃতুর পর শোকার্ত ব্যক্তি তাক্বদির নিয়ে সংশয়ে পড়েছে এমন উদাহরণ অনেক। আমাদের সমাজেও এমনটা দেখা যায়। তবে সংশয়ে পড়ার আরেকটি কারণ অবাক করার মতো। অ্যামেরিকান মুসলিমদের মধ্যে অনেকে সংশয়ে পড়ে যাচ্ছে কারণ তারা আবিস্কার করছে যে ধর্ম পালন করে সুখ (happiness) পাওয়া যায় না। এ জরিপ অনুযায়ী অ্যামেরিকান মুসলিমদের কাছে আল্লাহ আছেন কি না, এ প্রশ্নের চেয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে সুখ পাওয়া যাবে কি না – এ প্রশ্ন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। একজন অংশগ্রহনকারীর ভাষায় –
সোশাল মিডিয়া আর তাৎক্ষনিক সন্তুষ্টি (Instant Gratification) পাবার এ যুগে স্রষ্টার অস্তিত্বের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল –
আমার কি স্রষ্টার দরকার আছে?
ইসলাম আমাকে এমন কী দেবে যা অন্য জায়গায় পাবো না?
ইসলাম কি আমাকে সুখী জীবন দেবে?
পর্যবেক্ষন
এ জরিপ দুটো থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটো পয়েন্ট হল,
- বিজ্ঞান বা দর্শন না, আধুনিক সময়ে ইসলাম নিয়ে সংশয়ের মূল কারণ হল বিদ্যমান সামাজিক নৈতিকতার কাঠামোর সাথে ইসলামের সাংঘর্ষিক অবস্থান।
- আধুনিক পশ্চিমা চিন্তা ও নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত মানুষ পশ্চিমা কাঠামো অনুযায়ী ইসলামের অপরিবর্তনীয় বিভিন্ন বিষয়কে নতুন করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। না পারলে বা বিরোধিতার সম্মুখীন হলে ইসলাম ত্যাগ করছে।
যদিও এ জরিপ কেবল ৬০০ জন মানুষের ওপর চালানো, এবং এ থেকে পাওয়া ফলাফল ঢালাওভাবে এক্সট্রাপোলেট করা সম্ভব না, তবে আমি মনে করি মোটা দাগে এ ফলাফলগুলো বাংলাদেশের সমাজের ক্ষেত্রেও ভিন্ন মাত্রায় প্রযোজ্য। কারণ মিডিয়া, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক চাপ (Peer Pressure), সেক্যুলার-লিবারেল চিন্তাধারার মতো ফ্যাক্টরগুলো আমাদের সমাজেও উপস্থিত। যারা যতো বেশি পশ্চিমা মিডিয়া ও ন্যারেটিভের প্রতি উন্মুক্ত হবে, অথবা বাংলাদেশের “প্রগতিশীল সুশীলসমাজ” দ্বারা প্রভাবিত হবে – তাদের ক্ষেত্রে ফলাফল ততোবেশি অ্যামেরিকান সমাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবার সম্ভাবনা বাড়বে।
এর কারণ হল পশ্চিমা সমাজ (এবং তাদের বাজে ফটোকপি দেশীয় সুশীল-প্রগতিশীল সমাজ) মুখে বহু মতের সহাবস্থান এবং মরাল রেলেটেভিযমের (ভালোমন্দ সব কিছুই আপেক্ষিক। কোন কিছুই পরম বিচার খারাপ না। কোন কিছু পরম বিচারে ভালো না।) কথা বললেও আদতে তারা নিজেদের দর্শন ও নৈতিকতাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস কাজ করে যে, তারা নৈতিকভাবে সারা বিশ্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর তাদের নৈতিকতা ও দর্শন হল লিবারেলিযম ও সেক্যুলার হিউম্যানিযম, যা ইসলামের সাথে আগাগোড়া সাংঘর্ষিক। স্বাভাবিকভাবেই এই নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিচার করলে ইসলামে অনেক অনেক কিছু, অনৈতিক, অমানবিক, হিংসাপূর্ণ। এটা হল সেই নৈতিকতা যেটা সমকামিতা, যিনা, অবাধ যৌনতা, সুদ, শিরক, কুফর, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ অবমাননাসহ সকল ধরণের নোংরা আবর্জনার বৈধতা দেয়। এটা হল সেই নৈতিকতা যেটা “ইয়াযিদি মেয়েদের বাঁচাতে” ইরাকে শহরের পর শহর ধ্বংস করে ফেলে, হাজার হাজার মানুষকে কার্পেট বম্বিং করে হত্যা করে, কিন্তু যখন তাদের সগোত্রের ত্রানকর্মীরা ক্ষুধার্থ নারী ও শিশুদের যৌন সংগমে বাধ্য করে তখন বিষয়টা চেপে যায়। এটা হল সেই নৈতিকতা যেটা নিজেদের আধুনিক হওয়া নিয়ে গর্ব করে, “পশ্চাৎপদ” বিভিন্ন সমাজকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু গতকালের ঔপনিবেশিক লুটপাট, ধর্ষন আর অত্যাচারের ভিত্তির ওপর যে তাদের বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে, সেটা ভুলে যায়। এ নৈতিকতা ও দর্শন ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়াই স্বাভাবিক।
যখন মুসলিমরা দীর্ঘসময় ধরে এমন আদর্শ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত সমাজে বসবাস করে, অথবা এমন আদর্শের প্রতি উন্মুক্ত হয় – ক্রমাগত মিডিয়া, আড্ডা, আলোচনা, বিতর্কে এসব ধ্যানধারণার পুনরাবৃত্তি শুনতে থাকে – যখন তাদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে অজ্ঞতা ও হীনমন্যতা কাজ করে – এবং যখন তারা এগুলোকে গ্রহণ করতে শুরু করে – তখন অবধারিতভাবেই তার চিন্তার জগতে দুটো বিপরীতমুখী আদর্শের সংঘর্ষ ঘটে। আর কুফর দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সংঘর্ষের কী ফলাফল আসতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
টিভি, সিনেমা, গান, গল্পের মাধ্যমে ক্রমাগত কিছু বিশ্বাস ও আচরণকে আমাদের সামনে কিছু অনৈতিক ও অস্বাভাবিক বিষয়কে “স্বাভাবিক” হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেমন ৯০ এর দশকে জন্মানো প্রজন্মের চেয়ে, নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকে জন্ম নেয়া বাংলাদেশীদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সমকামিতা ও বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতার মতো বিষয়গুলোর গ্রহনযোগ্যতা বেশি। প্রথম প্রথম ধাক্কা লাগলে একসময় আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সয়ে যাচ্ছে। এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম আসছে। পরবর্তী প্রজন্ম অস্বাভাবিককেই “স্বাভাবিক” হিসেবে বিশ্বাস করছে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মূল্যবোধ আর নৈতিকতার মাপকাঠি বদলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা যে সবসময় স্বেচ্ছায়, সচেতনভাবে ঘটছে, তা না। যেহেতু কিশোর-তরুণদের ইসলামের ব্যাপারে জানার ব্যাপারে বিশাল গ্যাপ থেকে যাচ্ছে, তাই তারা অজান্তেই পশ্চিমা চিন্তাকেই নিজেদের ডিফল্ট দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে গ্রহন করছে।
বিজ্ঞান ও দর্শন সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো চেয়ে মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো বেশি জীবনঘনিষ্ঠ। বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক তত্ত্ব-তর্ক সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে না। বিশেষ করে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে কোন উপসংহারে পৌছানোর ক্ষেত্রে এসব বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা থেকে নিশ্চিত কোন ফলাফল পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো সরাসরি মানুষের ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করে। যিনার ব্যাপারে আমার ধারণা কী, সেটা আমার আচরণকে প্রভাবিত করবে। মানবতাকে আমি কি ইসলামের অবস্থান থেকে দেখবো নাকি সেক্যুলার হিউম্যানিযমের অবস্থান থেকে দেখবো, সেটা শারীয়াহ নির্ধারিত শাস্তির (হুদুদ) ব্যাপারে আমরা চিন্তাকে প্রভাবিত করবে। নৈতিকতার শিক্ষা কি আমি মিডিয়া কিংবা অধিকাংশ মানুষ কী বলে, সেখান থেকে নেবো নাকি কুরআন-সুন্নাহ থেকে নেবো, সেটা ইসলামের ব্যাপারে আমার মনোভাবকে প্রভাবিত করবে।
একারণে সংশয় থেকে মুসলিমদের রক্ষার জন্য বিজ্ঞান ও দর্শনসংক্রান্ত আলোচনার বদলে নৈতিকতাসংক্রান্ত প্রশ্নগুলোর আলোচনা বেশি গুরুত্বপূর্ন। যেমন কুরআনে অবৈজ্ঞানিক আয়াত আছে কি না, এর চেয়ে নারীর ব্যাপারে ইসলামের অবস্থানই নৈতিক – এ আলোচনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়া কিংবা তাদের সাথে তর্ক করার চেয়ে সেক্যুলার হিউম্যানিযম, লিবারেলিযম এবং পশ্চিমের বর্তমান ও অতীত ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানসংক্রান্ত আলোচনায় বিবর্তনবাদকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।
সংশয় নিরসনে “মডারেট/অ্যামেরিকান/পশ্চিমা ইসলামের” পদ্ধতিগত ব্যর্থতা
একটু খেয়াল করলেই স্পষ্ট হবার কথা জরিপে সংশয়ের উৎস হিসেবে উঠে আসা বিষয়গুলোর অধিকাংশেরই সম্পর্ক ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবের সাথে। ধরুন আপনি বাংলাদেশের দুটো প্রধান রাজনৈতিক দলের কোন একটার সদস্য বা সমর্থককে বলেন – “তোমার দল অমুক অমুক অপরাধের সাথে জড়িত। এটা একটা সন্ত্রাসী দল। এ আদর্শ বিষাক্ত”। আপনার কি মনে হয় একজন, এক লক্ষ বা এক কোটি বারবার এই কথা বলতে থাকলে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী তার আদর্শ ত্যাগ করবে? বাস্তবতা উল্টো সাক্ষ্য দেয়।
সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদসহ বিভিন্ন ধরণের আদর্শের লোকজন নিজ আদর্শের কিছুসংখ্যক মানুষের কাজের ওপর ভিত্তি করে নিজ আদর্শ ত্যাগ করে না। অথচ চিরন্তন সত্যকে কেবল মিডিয়ার একপেশে ও বিকৃত প্রপাগ্যান্ডার ওপর ভিত্তি করে মানুষ ত্যাগ করছে? দূষিত রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারীরা যতোটুকু দৃঢ়তা দেখাতে পারছে, ইসলামের অনুসারীরা সেটা পারছে না? কেন? একজন ব্যক্তি যদি আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল-কে সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে স্বীকার করে নেয়, যদি মুহাম্মাদকে ﷺ আল্লাহর রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করে, কুরআনকে আল্লাহর কালাম হিসেবে স্বীকার করে, এবং ইসলামকে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হিসেবে বিশ্বাস করে – তাহলে কীভাবে সে আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে? আল্লাহর প্রজ্ঞা ও সিদ্ধান্তের চাইতে নিজের কিংবা সমাজের বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়?
মূল সমস্যাটা হল অজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং পারিপার্শ্বিক চাপ। মানব অস্তিত্ব সম্পর্কে নিগূঢ় কোন প্রশ্নের তুলনায়, “পাছে লোকে কিছু বলে” – এই উৎকণ্ঠা আর স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়ার প্রবণতা এই মুসলিমদের সংশয়ের পেছনে বেশি ভূমিকা রাখছে। তাই এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করতে হবে। পশ্চিমা মানদন্ড অনু্যায়ী না, আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হিসেবে, আসমান ও যমিনের মালিকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ দিকনির্দেশনা হিসেবে, মানুষের ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি এই মুসলিমদের দায়িত্ব হল এমন পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসা যা ইসলামের মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও চেতনার পরিপন্থী। যদি আপনি প্রতিদিন এমন কোন আড্ডায় যান, যেখানে নিয়মিত সিগারেট খাওয়া হয়, তাহলে আপনার সিগারেট খাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। যদি সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে চান তাহলে আপনার ফ্রি-মিক্সিং ও মিক্সড গ্যাদারিং এড়িয়ে চলতে হবে, এড়িয়ে চলতে হবে এমন সবকিছু যা আপনাকে এধরনের সম্পর্কের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একইভাবে আপনাকে এমন সমাজ থেকে, এমন ভূমি থেকে বের হয়ে আসতে হবে যেখানে অবস্থান করা, আপনার অথবা আপনার পরিবারের কোন সদস্যের ঈমানকে হুমকির মুখে ফেলে।
যদিও ইয়াক্বিন ইন্সটিটিউটের রিপোর্টে বলা হয়েছে – the overwhelming majority of Islamic doctrine and practice is wholly compatible with living as an American citizen – কিন্তু বাস্তবতা হল অ্যামেরিকার নাগরিক হিসেবে অবস্থান করা, অ্যামেরিকার মতো সমাজে অবস্থান করাই মুসলিমের ইমানের জন্য ঝুঁকির কারণ। অ্যামেরিকান মুসলিমদের সংশয়ের পেছনে বড় একটা কারণ তাদের অ্যামেরিকাতে অবস্থান। আজকে যারা ইসলাম ত্যাগ করছে, তাদের অধিকাংশের পরিবারই এক বা দু প্রজন্ম আগে পশ্চিমে এসেছে। তাদের বাপ-দাদারা যখন অ্যামেরিকাতে ঢুকেছিলো তখন বেশিরভাগই দশজন মুসলিমের মতো বিশ্বাস ও চিন্তা নিয়েই ঢুকেছিল। হয়তো তাদের মধ্যে অনেকেই অত্যন্ত আমলদার ছিল। কিন্তু মাত্র এক/দুই প্রজন্মের ব্যবধানে অবস্থা পাল্টে গেছে। মুসলিম পরিবার থেকে মুরতাদ সন্তান, নাতিনাতনি বের হচ্ছে। এর পেছনে অ্যামেরিকার মতো একটি সমাজে অবস্থান করার ভূমিকাকে কোনভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
এক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত এ খোড়া অজুহাত দেয়ার সুযোগ নেই যে, মুসলিম অধ্যুষিত ভূখন্ডগুলোতেও একই অবস্থা। কারণ বাস্তবতা। মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে ইসলামী শারীয়াহ নেই, শাসনের ক্ষেত্রে তাওহিদ নেই। তবুও এখনো পশ্চিমের সাথে এ ভূখন্ডগুলোর সমাজ-বাস্তবতার পার্থক্য আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে আস্তে আস্তে মুসলিম ভূখন্ডগুলোও একই পরিণতির দিকে আগাচ্ছে কিন্তু মুসলিম ভূখন্ডগুলোর সামাজিক-নৈতিক অবস্থার অবনতি ও অবক্ষয় এখনো অ্যামেরিকার মতো পর্যায়ে পৌছেনি (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। অন্ধ, অজ্ঞ, বিভ্রান্ত বা আত্মপ্রতারনাকারী ছাড়া কেউ এ ব্যাপারে দ্বিমত করার কথা না।
ইন ফ্যাক্ট, কেন মুসলিমদের জন্য কাফিরদের ভূমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা বৈধ না, এ প্রশ্নের জবাব আলিমগণ স্পেসিফিকালি ইসলামের প্রতি কমিটমেন্ট, নৈতিকতা, আচরণ এবং ইমান নষ্ট হবার কথা বলেছেন। শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ ইবন উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন –
- “কাফির দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা একজন মুসলিমের দ্বীনি দায়িত্ব, নৈতিকতা, আচরণ ও আদবের জন্য মারাত্মক হুমকি বহন করে। আমরা অনেকেই দেখেছি যারা এসব দেশে সেটেল হয়েছে তারা গোমরাহ হয়েছে, এবং পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে। তারা ফাসিক-ফাজির হয়ে ফিরে এসেছে। অনেকে মুরতাদ হয়ে গেছে, এবং নিজের দ্বীনসহ সব ধর্মে অবিশ্বাসী হয়ে ফিরেছে। তারা দ্বীনকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এবং দ্বীন এবং এর অনুসারীদের; অতীত ও বর্তমান, নিয়ে বিদ্রূপ করে। আমরা আল্লাহর কাছ আশ্রয় চাই।
কীভাবে একজন মুসলিম কাফিরদের ভূখন্ডে জীবন কাটানোর ব্যাপারে পরিতৃপ্ত হতে পারে, যেখানে প্রকাশ্যে কুফরের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়, এবং আল্লাহ ও রাসূলের ﷺ আইন ব্যাতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা হয়? নিজ চোখে এসব দেখার পর, নিজ কানে এসব শোনার পর একসময় অন্তর এগুলোর অনুমোদন দেয়া শুরু করে, এমনকি ব্যক্তি মনে করতে শুরু করে যে সে এবং তার পরিবার আসলে ঐ মাটিতে থাকার জন্যই…অথচ সে, তার স্ত্রী এবং তাদের সন্তানেরা – তাদের দ্বীন এবং নৈতিকতা – চরম হুমকির সামনে।” [মাজমু’ ফাতাওয়া আশ-শায়খ ইবন উসাইমিন, ফতোয়া নম্বর ৩৮৮]
শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ বলেছেন –
- “…আপনারও আর মনে রাখা উচিৎ যে লাভের আশায় ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে মূলধন সংরক্ষন উত্তম। মুসলিমের মূলধন হল তার দ্বীন। একজনের মুসলিমের উচিৎ না ক্ষণস্থায়ী কোন দুনিয়াবি প্রাপ্তির আশায় এ মূলধনকে হুমকিতে ফেলা…
আমরা পরামর্শ দেবো, কোন কাফির দেশে না যাবার এবং সেখানে সেটেল না হবার, ব্যতিক্রম হল এমন পরিস্থিতি যেখানে আপনি বাধ্য সাময়িকভাবে সেখানে যাবার, যেমন এমন কোন চিকিৎসা নেয়ার জন্য, যা মুসলিম দেশগুলো পাওয়া যায় না।” [ Should he go back and live in a kaafir country? – https://islamqa.info/en/27211]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
- “যে কোন মুশরিকের সাথে বসবাস করে এবং তাদের সাথে মেশে সে তারই মতো৷” (আবু দাউদ)
এবং
- “মুশরিকদের মধ্যে বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিম থেকে আমি মুক্ত।” (আবু দাউদ)
মালিকুল মুলক আল্লাহ বলেছেন –
- নিশ্চয় যারা নিজেদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল। [সূরা নিসা, ৯৭]
সমস্যার কারণ ও কার্যকরন স্পষ্ট। সমস্যা হল মডারেট ইসলামের প্রচারকরা এ সহজ সত্যকে স্বীকার করতে নারাজ। তারা প্রথমত পশ্চিমে অবস্থান করাকে সমস্যা মনে করেন না, বরং অনেকেই নানাভাবে এটাকে জায়েজ করা এমনকি ইবাদত বলে প্রমাণ করারও লজ্জাজনক চেস্টা করেন। অন্যদিকে তারা স্পষ্টভাবে, দৃঢ়তার সাথে ইসলামের অবস্থান, ইসলামের শিক্ষা ও ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন না। তারা একটা অ্যাপলোজেটিক স্ট্যান্স নেন। লিবারেল-সেক্যুলার দর্শনকে বাদ না দিয়ে, খণ্ডন না করে, এগুলোর ঠিক করে দেয়া মাপকাঠি দিয়েই ইসলামকে সঠিক প্রমাণ করার চেস্টা করেন। তারা নানা বিচ্ছিন্ন মত খুজে বের করে করে, অ্যামেরিকা বা পশ্চিমের সাথে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে না তারা সেক্যুলার-লিবারেল মানদন্ডে উত্তীর্ন হতে পারেন, না মুসলিমদের সংশয় দূর করতে পারেন, আর না ইসলামের অনুসরণ করতে পারেন।
এছাড়া এধরনের অ্যাপ্রোচ দীর্ঘমেয়াদে আরো বেশি ছাড়, আরো বেশি আপোষের দিকে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য। কারণ তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এই কুফফারের দর্শন, নৈতিকতা ও সমাজের নীতি অনুযায়ী, ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী না। তারা নিজেরাই নিজেদের এমন এক কোণার দিকে ঠেলে দিয়েছেন যেখানে ছাড়ের পর ছাড় দেয়া ছাড়া অবস্থান টিকিয়ে রাখার আর কোন উপায় তাদের নেই। আর যতো ছাড়ই তারা দিক না কেন কখনোই শেষরক্ষা হবে না। কারণ আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জালা আমাদের এ ধরণের পদ্ধতির অমোঘ পরিণতির কথা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।
- আর ইয়াহূদী ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর। বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’ আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তার পর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না। [আল-বাক্বারা, ১২০]
সুতরাং দুটো বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন –
১) পশ্চিমে অবস্থান করা এধরনের মডারেট স্কলার, দা’ঈ বা প্রতিষ্ঠান থেকে ইলম নেয়া, তাদের মত-অবস্থানের অনুসরণ করা সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলতে হবে। যেসব বিচ্ছিন্ন, অথবা নব-উদ্ভাবিত মত তারা দিচ্ছেন সেগুলো একটা অস্বাভাবিক ও প্রেশারাইযড সিচুয়েশান থেকে বলা। একদিকে অ্যামেরিকান/পশ্চিমা সরকারের চাপ, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের ইসলাম থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাওয়া, সংশয়, রিদ্দা – এ দু’য়ের মাঝে পড়ে তারা এধরনের অবস্থান নিচ্ছেন। তারা যেটাকে ইজতিহাদ হিসেবে উপস্থাপন করছে আসলে সেটা অসহায়ত্ব, ডেসপারেশান এবং কাপুরুষতা। সমকামিতা কিংবা এ জাতীয় বিষয়ে তারা আজ যেসব কথা বলছেন, মুসলিমরা বিজয়ী অবস্থান থাকলে তাদের কয়জন এধরণের কথা বলতেন?
২) পশ্চিমা দর্শনের মোকাবেলায়, ইসলামের সমর্থনে কিংবা আস্তিক-নাস্তিক তর্কে তারা যে অ্যাপ্রোচ নিয়েছেন – বিজ্ঞান, মানবতা, অধিকার – ইত্যাদি দিয়ে ইসলামকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা যথাসম্ভব বাদ দিতে হবে। কারণ এটা একটা রেসিপি ফর ডিসাস্টার। সহজাতভাবেই একটা দুর্বল, রক্ষনাত্বক অবস্থান। এক সময় না এক সময়, মানুষের বানানো এসব ফ্রেইমওয়ার্কে ইসলাম আটকে যাবেই। তাই এই অ্যাপ্রোচ বাদ দিয়ে, ইসলামের অবস্থানের যৌক্তিকতা সহজবোধ্যভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা উচিৎ। অজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব দূর করা উচিৎ। এবং এসব ইস্যু নিয়ে সঠিক অবস্থান এবং তার পেছনের হিকমাহ, বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরা উচিৎ। হিকমাহর সাথে দাওয়াহ করা উচিৎ, তবে হিকমাহর অর্থ ছাড়া দেয়া না, এটাও মনে রাখা দরকার। মিনমিনে তোষামোদি অনুযোগ-অভিযোগ দিয়ে আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা যায় না। শক্তভাবে দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে মুখোমুখি মোকাবেলা করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে লিবারেল প্রপাগ্যান্ডা ও রেটোরিকের বিরুদ্ধে অ্যামেরিকা ও ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের (Alt Right, Identitarian, White Supremacists, Neo-Nazis) সাফল্য থেকেও এ চিরাচরিত সত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
উপসংহার
দিনশেষে বাস্তবতা হল, সবসময় এমন কিছু মানুষ থাকবে যাদের মধ্যে সংশয় থেকে যাবে। এমন কিছু মানুষ থাকবে যারা মুরতাদ হয়ে যাবে। আর কেউ কেউ মুনাফিক হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে। ভেতর থেকে ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, ষড়যন্ত্র করবে। যাদের অন্তরে রোগ আছে এটা হবেই। হিদায়াত একমাত্র আল্লাহরই পক্ষ থেকে। কিন্তু আমরা যেটা করতে পারি তা হল মুসলিমদের মধ্যে সংশয় তৈরি হবার মাত্রা কমিয়ে আনা। যারা দুর্বল ইমান, অজ্ঞতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদির কারণে ফিতনাতে পরে যাচ্ছেন, আমরা তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি।
আর এটা করা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা আনঅ্যাপোলোজেটিকালি ইসলামকে আকড়ে ধরবো, আমাদের মুসলিম পরিচয়কে আকড়ে ধরবো। ইসলামের হুকুম আহকামের ব্যাপারে সংশয়-সন্দেহ তখনই সৃষ্টি হয় যখন আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের ব্যাপারে অন্তরে সংশয়-সন্দেহ থাকে। হুকুম-আহকাম কিংবা নৈতিকতা নিয়ে সংশয় তাওহিদ নিয়ে সংশয়ের সিম্পটম। ইসলাম নিয়ে, ইমান নিয়ে যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে, যদি ইসলামের চেয়ে অন্য কোন নৈতিকতা, দর্শন কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রিয় হয়, তাহলে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশয়ে পরাটাই স্বাভাবিক। ইসলাম হল একমাত্র সিস্টেম যেটা ১০০% ঠিক। বাকি সব বিভিন্ন মাত্রা ও অনুপাতে বাতিল। বাতিল এই সিস্টেমগুলোর মধ্যে কোনটাতে ১০% কোনটাকে ২০, কোনটাতে ৩০% ভালোর মিশ্রন থাকতে পারে, কিন্তু বাকিটুকু বাতিলই। আর এগুলোর সাথে যখন আমরা ইসলামকে মেলাতে যাবো তখন ভেজাল লাগবেই। কখনো হক্ব তো বাতিলের কাঠামোতে বসতে পারে না।
একট চরম মাত্রার বস্তুবাদী ভোগবাদী কালচারের নৈতিকতার ধারণার সাথে ইসলাম মিলবে না এটাই স্বভাবিক। বদ্ধ পাগল না হলে কে ইসলামকে এটার সাথে মেলাতে যাবে?
মুসলিমদের হীনমন্যতা ও সংশয়ের বড় একটি কারণ হল মিডিয়া এবং পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সক্রিয় সমর্থনের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রভাব বিস্তার করা লিবারেল-সেক্যুলার দর্শন। এ চিন্তাধার নৈতিকতার এমন এক কাঠামো দাড় করায় যা ইসলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক। মডারেট সিভিল ডেমোক্রেটিক “ইসলাম” ও এর প্রচারকদের সমস্যা হল তারা পশ্চিমা অবস্থানের প্রথম ধাপটাকে (Premise) মেনে নিয়ে, ইসলামকে পশ্চিমের মানদন্ডে উত্তীর্ন করাতে চান। যার ফলাফল হল আম ও ছালা দুটোই হারানো। এর ফলে তারা সংশয়ের পথ ও সম্ভাবনাকে আরো বেশি উন্মুক্ত করে দেন।
এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান হল সালাফ আস-সালেহিনের বুঝ অনুযায়ী ইসলাম প্রচার করা, পশ্চিমের সাথে কম্প্যাটিবল “ইসলাম” না। পশ্চিমের ছাঁচে ফেলে ইসলামকে দেখলে হবে না, বরং ইসলামের অবস্থান থেকে পশ্চিমের মোকাবেলা করতে হবে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা আমাদের শেকড়ে ফিরে যাবো, হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলবো, পশ্চিমা আদর্শের আবর্জন ত্যাগ করবো এবং ঐ পথের ওপর ফিরে যাবো যে পথে প্রথমবার ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মক্কা বিজিত হয়েছিল।
ইসলাম নিয়ন্ত্রিত হয় না, নিয়ন্ত্রন করে।