আত্মত্যাগ, বিজয় আর সুবিধাবাদের গল্প


আত্মত্যাগ, বিজয় আর সুবিধাবাদের গল্প

কল্পনা করুন, বিশাল প্রাসাদে বন্দী এক দল মানুষ। বের হবার দরজা কেবল একটা। কিন্তু সে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। দরজা খুলতে হলে লাগবে চাবি। প্রাসাদের ভেতরের এক পাশের দেয়ালে দশটা গর্ত। এর যেকোন একটায় আছে দরজার চাবি। কোন গর্তে চাবি আছে সেটা কেউ জানে না।

হিসেব খুব সহজ তাই না?

গর্তগুলো খুঁজে খুজে চাবিটা খুঁজে বের করে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়।
হ্যা হিসেবটা সোজা। তবে একটা জটিলতা আছে। ১০টা গর্তের একটার মধ্যে তো চাবি, কিন্তু বাকি ৯টার মধ্যে আছে বিষাক্ত কালকেউটে সাপ।

সহজ সমীকরণের এ জটিলতার কারনেই বুঝি কেউ সাহস করে আগাচ্ছে না। সবাই বসে আছে নিস্ক্রিয় হয়ে। কেউ কেউ প্রাসাদের তুলনামূলক আরামদায়ক কোন কোণা বেছে নিয়ে শুরু করে দিয়েছে বিছানাপাতি গোছানো। যেন বন্দীত্বকেই নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে সবাই।

শেষমেষ একজন উঠে দাড়ালো। চোখে ইস্পাতের দৃঢ়তা। আত্মবিশ্বাসী পায়ে হেটে গেল গর্তগুলোর কাছে। একটা গর্ত বেছে নিয়ে ভাবলেশহীন মুখে হাত ঢুকিয়ে দিল…সাপ ছোবল দিল। মানুষটা মারা গেল প্রায় সাথে সাথে।

উঠে দাড়ালো আরো একজন। সতর্কতাস্বরূপ হাতে পেচিয়ে নিল একটুকরো কাপড়। সযত্নে এড়িয়ে গেল প্রথমজনের বাছাই করা গর্তটা। তারপর বাকি ৯টা থেকে বেছে নিল একটা গর্ত। কিন্তু হাতের ঐ টুকরো কাপড়ে তেমন একটা লাভ হল না। দ্বিতীয়জনও মারা পড়লো সাপের কামড়ে।

উঠে দাড়ালো তৃতীয় আরেকজন। তারপর চতুর্থ, তারপর পঞ্চম। প্রত্যেকে সাধ্যমত চেষ্টা করলো সাপের ছোবল থেকে হাত বাচানোর। কিন্তু একে একা মারা পড়লো সবাই।

এই পুরো সময়টা জুড়ে অধিকাংশ মানুষ বসে থাকলো নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে। সবার মুক্তির জন্য ওরা যখন একে একে মারা যাচ্ছিল, সেই সময়টা নিস্ক্রিয় দর্শকরা কাটাচ্ছিল ঠাট্টা আর সমালোচনায়। কেউ ঠাট্টা করলো, কেউ বোকা, গাধা, নির্বোধ, আবেগী আর জযবাতি বলে গাল দিল। ‘আর যাই হোক চাবি খোঁজার চেষ্টায় বেঘোর প্রাণ দিতে হচ্ছে না’, এ তৃপ্তি নিয়ে বাকিরা বসে রইলো সন্তুষ্ট মুখে।

একে একে মারা পড়ল নয়জন। গর্ত বাকি একটা। হাত বাড়িয়ে শেষ গর্তটা থেকে চাবিটা বের করে আনলো দশম জন। ধীর নিশ্চিন্ত পায়ে হেটে গিয়ে খুলে দিল প্রাসাদের দরজা। এতক্ষণের নিষ্ক্রিয় দর্শক আর সমালোচকরা তখন আনন্দে আত্মহারা। চারপাশে জড়ো হয়ে কান ফাটানো শব্দে হাততালি দিচ্ছে সবাই। কেউ আবেগে কাঁদছে। হাতে চাবি ধরা মানুষটাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রশংসার বন্যায়।
এ ব্যাপার কল্পনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসুন।

বলুন তো এ মুক্তি, এ বিজয় আসলে কে আনলো?

এ বিজয় কি দশম ব্যক্তির অবদান? নাকি তাঁর আগের নয়জনের অবদান আরো বেশি? সবার আগে যে মানুষটা উঠে দাড়িয়েছিল, নিশঙ্ক চিত্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল সাপের গর্তে, যারা তাঁর পর এসেছিল, তাদের তুলনায় তাঁর অবদান কি বেশি না?

আমাদের কল্পনার প্রাসাদের বন্দী মানুষগুলোর মতোই মুসলিম উম্মাহও আজ পার করছে বন্দিত্বের সময়। সত্যিকার অর্থে পরাজিত তো সে, যে সাপের কামড়ের ভয়ে মুক্তির চেষ্টাই করে না। ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে বন্দী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া তাঁর পছন্দনীয়।

কিন্তু যারা নিঃসঙ্কোচে, নির্ভীক চিত্তে উঠে দাঁড়ায়। সব প্রতিকূলতা আর ঝুঁকি সত্ত্বেও মুক্তির জন্য, বিজয়ের জন্য যারা চেষ্টা চালায়। যারা বিজয় দেখে যেতে পারবে না জেনেও বিজয়ের জন্য আল্লাহর রাস্তায় উজাড় করে দেয় জানমাল সম্পদ, তারাই হল গৌরবের উত্তরসুরী। তাঁরাই উম্মাহর অগ্রবর্তী বাহিনী।

আপনিও এ বাহিনীর সদস্য হতে পারবেন। তবে দুটো শর্ত আছে –

১। এমন কোন গর্তে হাত দিতে পারবেন না, শরীয়াহ এবং ইতিহাসের শিক্ষা যেগুলোর ব্যাপারে দেখিয়ে দিয়েছে যে সেখানে চাবি নেই।

২। যারা আপনার আগে গেছেন এবং ছোবল খেয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। তারা যেখানে শেষ করেছেন শুরু করতে হবে সেখান থেকে। তাদের ভুলগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে অধ্যায়ন না করে শুধু সাহস, বীরত্ব ও উত্তম নিয়্যাত নিয়ে এগোলো হবে না। তা না হলে আপনি আবারো ঐ গর্তেই দংশিত হবেন যে গর্ত থেকে এর আগে আপনার ভাই ছোবল খেয়েছেন। এবং – মুমিন এক গর্ত থেকে দুইবার দংশিত হয় না।

যদি এ দু শর্ত মেনে এগিয়ে যান তাহলে নিশ্চিত থাকুন, বিজয় আমাদের হবেই।

যেখানে ঈমান আছে, সেখানে হতাশার কোন সুযোগ নেই।

ড. ইয়াদ কুনাইবী

আয়নাঘর


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *