রাষ্ট্র ধর্ম, রথের ঘোড়া


প্লেইটোসহ বিভিন্ন গ্রীক দার্শনিকের মতে আবেগ ও ইন্ট্যুইশানের সাথে যুক্তির সম্পর্ক হল রথের ঘোড়া আর সারথীর সম্পর্কের মতো। মানুষের আবেগ, ইন্ট্যুইশান হল রথের সামনে থাকা দুটো ঘোড়ার মতো। যুক্তি, বুদ্ধি হল সারথী। সাধারণ মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির অবস্থা আনাড়ি সারথীর মতো। ঘোড়াদুটোকে নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে সে নিয়মিত হিমশিম খায়। অনেক সময় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে। তবে প্রাজ্ঞ দার্শনিকদের যুক্তি-বুদ্ধি হল চৌকস সারথীর মতো। পেশাদারী দক্ষতায় সে আবেগ আর ইন্ট্যুইশানের ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রন করে।

জনাথন হাইডটসহ আধুনিক সোশ্যাল এবং এভ্যুলুশানারি সাইকোলজিস্টদের অনেকের মতে সম্পর্কটার ধরণ আসলে ভিন্ন। আবেগ আর যুক্তির সম্পর্কটা রথের সারথী আর ঘোড়ার মতো না। বরং এই সম্পর্কের তুলনা চলে দেশের প্রেসিডেন্ট আর তার প্রেস সচিবের সম্পর্কের সাথে। প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের মতো করে। তারপর সেটা জানিয়ে দেয় প্রেস সচিবকে। এবার প্রেস সচিবকে বেচারাকে পুরো দেশের সামনে এসে প্রেসিডেন্টের সেই সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে হয়। নানান ভাবে যৌক্তিক প্রমান করতে হয়।

সিদ্ধান্ত নেয় প্রেসিডেন্ট। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সেটা জাস্টিফাই করার কাজ হল প্রেস সচিবের। আবেগ-ইন্ট্যুইশান হল প্রেসিডেন্ট। যুক্তি হল তার প্রেস সচিব। মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়ার পর, কোন এক দিকে ঝোঁকার পর যুক্তি সেটাকে নানানভাবে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে।

দুটো উদাহরণই ইন্ট্রেস্টিং। তবে আমার মনে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট আর প্রেস সচিবের উদাহরণই সঠিক। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগে সিদ্ধান্ত নেই আবেগ, অনুভূতি আর ইন্ট্যুইশানের ওপর ভিত্তি করে; তারপর মাথা খাটিয়ে সেটার পেছনে যুক্তি দাড় করাই। খুব বুদ্ধিমান মানুষও এমন করে থাকেন। আর এই প্রবণতার কারণেই আমরা যখন তর্কের সময় কোন উদাহরণ টানি তখন সেটা এমনভাবে বাছাই করি যাতে করে সেটা আমার অবস্থানকে সমর্থন করে। মূল আলোচনার সাথে এই উদাহরণ আসলে কতোটুকু খাপ খাচ্ছে, কিংবা আদৌ মিলছে কি না, সেটা নিয়ে আমরা তেমন একটা মাথা ঘামাই না। প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এখন প্রেস সচিব কীভাবে সাফাই গাইবে, সেটা তার ব্যাপার।

রাষ্ট্রধর্মের গুরুত্ব, রাষ্ট্রধর্ম থাকা না থাকা নিয়ে তর্কের বড় একটা অংশ জুড়ে থাকে নানান ধরণের উদাহরণ। এই উদাহরণগুলোর অবস্থান প্রেসিডেন্ট-প্রেস সচিব মডেলের ভালো প্রমাণ। বিভিন্ন উদাহরণ এনে মানুষ নিজ অবস্থানের যৌক্তিকতা প্রমানের চেষ্টা করে। যেমন, ষোল আনা সেক্যুলার রাষ্ট্রেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা নিয়ে খুব গুরুত্ব নিয়ে চিন্তা করা, আন্দোলন করা কেন জরুরী, সেটা বোঝানোর জন্য অনেকে নেংটি পরা লোকের উদাহরণ দেন – .এক লোকের পুরো শরীর উদোম। শুধু একটা নেংটি পরা। এখন সারা গা খালি হবার কারণে কি আপনি নেংটি খুলে ফেলতে বলবেন? আর কিছু না থাক, কমসেকম নেংটি তো আছে! পুরোপুরি জন্মদিনের পোশাকে থাকার চেয়ে নেংটি পরে থাকা কি একটু হলেও কম খারাপ না?

ভালো উদাহরণ। শুনতে বেশ কনভিন্সিং। এই কনভিন্সিং উদাহরণ কেন রাষ্ট্রধর্মের ক্ষেত্রে খাটে না সেটার বেশ কিছু কারণ আমি দেখাতে পারবো। কিন্তু সেটা করে আসলে তেমন কোন লাভ নেই। আফটার অল, আমরা সবাই নিজ নিজ উপসংহার অনুযায়ী-ই আমাদের যুক্তি সাজাই। তাই যুক্তিখন্ডন করে লম্বা আলোচনা করা অধিকাংশ সময়ই তেমন কার্যকরী হয় না। তার বদলে আমি অন্য একটা কাজ করি। এমন কিছু উদাহরণ দেই যেগুলো আমার মতে, সেক্যুলার রাষ্ট্রে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম নিয়ে মাথাব্যাথার সাথে বেশি মেলে।

#১মনে করুন, এক লোক লুঙ্গি পরে রাস্তায় হাটছে। চমৎকার রঙ্গীন লুঙ্গি। সমস্যা হল, সে লুঙ্গি কোমর না বেঁধে মাথায় বেঁধেছে। মাথায় বাঁধা লুঙ্গি ছাড়া পুরো শরীরে আর একটা সুতোও নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে আপনি মুরুব্বি গোছের এক লোককে অনুরোধ করলেন –

‘ওস্তাদ! এই পাগল তো রাস্তায় নেংটা হয়ে হাঁটছে। তাকে থামান। কাপড় পরান।’

আপনার কথা শুনে মুরুব্বী মাথা চুলকে বললো,

‘যদিও ভুল জায়গায় পরেছে, কিন্তু টেকনিকালি সে লুঙ্গি পরে আছে। আর যতোক্ষণ কেউ লুঙ্গি পরে থাকবে (টেকনিকালি) ততোক্ষণ তাকে আসলে বাঁধা দেয়ার কিংবা জোর করে পোশাক পরানোর সুযোগ নাই’। এখন বলুন, এই লুঙ্গি থাকা ভালো নাকি খারাপ?

#২ বিশাল একটা দ্বীপ। সেখানে অনেক মুসলিম আছে, আবার কাফের-মুশরিকও আছে। পুরো গ্রামে কোন মাসজিদ নেই। তবে একটা সর্বধর্মীয় উপাসনালয় আছে। সেখানে একই সাথে মিম্বার আছে, মূর্তি আছে, ক্রুশ আছে, বুদ্ধ আছে। এক ছাদের নিচের সব আরকি। তবে ইতিবাচক দিক হল, সেই সর্বধর্মীয় উপাসনালয়ের সামনে একটা সাইনবোর্ড আছে, সেই সাইনবোর্ডে কালেমা লেখা। এই সাইনবোর্ডের কারণে বিশাল সংখ্যক মুসলিম সেখানে ঢুকে সালাত আদায় করে। এখন এই উপাসনালয়ের সামনে থেকে সাইনবোর্ড সরিয়ে দেয়া হলে এই দ্বীপের মুসলিমরা বুঝতে পারবে যে এটা আসলে মাসজিদ না, কুফর ও শিরকের জায়গা। এখানে সালাত আদায় হবে না। তখন অনেকে এই উপাসনালয়ে যাওয়া বন্ধ করবে। আবার অনেকে হয়তো বুঝে না বুঝে যাতায়াত চালিয়ে যাবে। এখন এই সাইনবোর্ড থাকা বেটার? নাকি বাদ দেয়া?

#৩প্রেমের মোহ আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমিকাকে হোটেলে এনে ‘ধর্ষন’ করেছে প্রেমিক। তারপর বলছে,

‘তোমাকে বিয়ে করার তো প্রশ্নই আসে না, তোমাকে এক ফোঁটা ভালোওবাসি না…স্মাইল ইমোজি’।

শুনে প্রেমিকা গগনবিদারী আর্তনাদে কান্না শুরু করেছে, ‘ধর্ষন করলা ভালো কথা, কিন্তু বিয়ে করবা না কেনো?!’।

রাস্তায় কান পেতে শোনা লোকজনও বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে,

‘আসলেই তো। না হয় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষন করলোই, কিন্তু পরে বিয়েটা করলো না কেন?!”

নোট – এটা সিরিয়াস লেখা না। এখানে চুলচেরা যুক্তি খোঁজার দরকার নেই। নানান রকম উদাহরণ দিয়ে যারা এই ইস্যুতে ‘আলোচনা’ করেন, এটা ঐ ধরণের আলোচনা। সিরিয়াসভাবে নেয়ার কিছু নেই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *