দরসে নিযামী এবং শেকড় রেখে শাখায় মনোনিবেশ


আমরা একথা স্বীকার করি যে উলামায়ে কেরামের বেশ কিছু অপারগতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু ব্যাংক কিংবা গণতন্ত্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে ‘জবর’ এর মূলনীতিতে উলামায়ে কেরামের কার্যক্রম অতোটা সহজসরল বিষয় বলে আমাদের মনে হয় না, যতোটা সংশ্লিষ্টরা দাবি করছে। বরং এটা নির্দিষ্ট চিন্তা-চেতনার ফসল, যা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। এখানে কিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ করা দরকার।

আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে পঠিত ‘দরসে নেযামী’র সিলেবাসের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।

এক) দরসে নেযামী ধরে নেয় যে ‘ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপস্থিতি’ আছে। আর এই কারণেই এর মাঝে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কিত রাজনৈতিক আদর্শের সামগ্রিক কোন কিতাবের অস্তিত্ব নেই।

দুই) দরসে নেজামীর প্রধান কাজ হল, ইসলামী রাষ্ট্র ও শিক্ষার উপস্থিতিতে সৃষ্ট হওয়া বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বের করা। অন্য অর্থে দরসে নেজামীর উদ্দেশ্য হল ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এমন মানুষ গড়া যারা শরীয়াহর বিধান মোতাবেক সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্ত কাজ পরিচালনা করবেন।

তিন) যেহেতু এই সিলেবাস ধরে নেয় যে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব আছে, তাই এর দর্শনকে ‘বিদ্যমান পরিবেশে অন্তর্ভুক্তি’ (how to fit in oneself in the given environment) এর নীতি বলা যেতে পারে। অর্থাৎ এর কর্মপদ্ধতি হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় এর ভেতর উদ্ভাবিত সমস্যার এমন সমাধান পেশ করা যাতে করে ইসলামী (অনুশাসনের আনুগত্যের) ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

চার) এজন্য ফিকহের কাজ হল শাখাগত বিষয়ে ফতোয়া দেয়া। কারণ সত্য তথা ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চেতনার পূর্ণাঙ্গতাকে (totality) মেনে নেয়ার পর শাখাগত বিষয়েরই কেবলমাত্র হুকুম দেয়ার সুযোগ থাকে।

যদি উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে কোন সন্দেহ নেই যে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপস্থিতিতে ‘বিদ্যমান পরিবেশে অন্তর্ভুক্তি’ অর্থাৎ fit in-এর মানহাজ বা পদ্ধতির চেয়ে উত্তম কোন পদ্ধতি নেই। কিন্তু যখন সামগ্রিকভাবে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনুপস্থিত তখন totality কে প্রত্যাখ্যান করে fit in-করার দর্শনের ভিত্তিতে শুধু শাখাগত বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার অর্থ হল মূল সমস্যার সমাধানের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে নিছক নবউদ্ভাবিত বিভিন্ন শাখাগত সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকা। ইসলামী রাষ্ট্রের উপস্থিতিতে এই কর্মপদ্ধতি সঠিক, কিন্তু ইসলামী শাসনের অনুপস্থিতিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই একই পদ্ধতি সমূহ বিপদের কারণ। কারণ যেই সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এখন fit in- করার পদ্ধতির সবক দেয়া হচ্ছে, সেই পরিবেশটাই অনৈসলামিক। এমন অবস্থায় fit in- করার নীতি অবলম্বনে অসংখ্য ক্ষতি আছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল, সমাজ ও রাষ্ট্রে সেক্যুলার ব্যবস্থার প্রভাব ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে আর এর ফলে উলামায়ে কেরামের প্রভাব আরো কমছে, সীমাবদ্ধত ও অপারগতা আরো বাড়ছে।

কোন নতুন সমস্যাকে যখন তার সম্পূর্ণতা (totality) থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হবে, তখন তার আসল রূপই পাল্টে যাবে। ফলে সমস্যার প্রকৃত রূপ অনুধাবন ও সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সম্পূর্ণতাকে উপেক্ষা করে বিদ্যমান ব্যবস্থায় fit in করার এই নীতির ভিত্তিতেই নিজেদের ১ হাজার বছরের সোনালী ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার বদলে আমরা ইংরেজদেরই দেয়া গণতন্ত্রে অংশ নিলাম। মজার বিষয় হল, স্বাধীনতা অর্জনের পরও আমরা নিজেদের ঐতিহাসিক অনুশাসনে (যেমন মোঘল বা তুর্কী খিলাফাহ ব্যবস্থা) ফিরে যাইনি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গ্রহণ করে নিয়েছি এবং এটাকেই ইসলামী বানানোর চেষ্টা শুরু করেছি।

ওপরের অংশটা ‘ভুল প্রশ্নের ভুল জবাব’ নামের বই থেকেই নেয়া। বইয়ের মূল ফোকাস যদিও ইসলামী ব্যাংকিং কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওপরের কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা আছে। বিভিন্ন ঘটনা ও ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আলিমগণের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং কোন বিষয়ে আলিমগণের কাছ থেকে রিয়েলিস্টিকালি কতোটুকু আশা করা যেতে পারে, এসব ব্যাপারে ওপরের এই কথাগুলোর আলোকে চিন্তা করলে ইন শা আল্লাহ্‌ বাস্তবতা অনেকটুকুই পরিস্কার হবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *