ধর্ম নিয়ে ধান্ধাবাজি


“আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসম্ভব রকম বিশ্বাস করি। বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আমার ফোনের রিংটোন দেয়া। আমি গভীরভাবে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মনে করি সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত, ৭১ এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু ঘটেনি, আর ঘটবেও না।

আর এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়েই আমি দৃঢ় গলায় বলছি, ৭১ নামের অনিন্দ্যসুন্দর নামের বছরটাতে ভুট্টো সাহেব, টিক্কা খান এবং রাও ফরমান আলী যা করেছিলেন তা ঠিকই করেছিলেন। তাদের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নৈতিক ছিল। যৌক্তিক ছিল। আমাকে গালি দিতে পারেন। কিন্তু আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাকে এই উপসংহারে এনেছে।

“আমি প্রচন্ড নারীবাদী একজন মানুষ। মাঝেমাঝে গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি – একজন পুরুষ হিসেবে পুরুষতন্ত্রের জঘন্য পাপের গন্ধ কি আদৌ কোনদিন আমার শরীর থেকে মুছবে? অনন্তকাল শাস্তিভোগ করলেও কি পুরুষতন্ত্রের অসহ্য অতলান্ত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে? উত্তর মেলে না। আমার ক্লান্ত দৃষ্টি বারেবারে আমার কাছেই ফিরে আসে।

এই গভীর নারীবাদী আমি শক্তভাবে বিশ্বাস করি, মেয়েদের সম্পত্তি, জমিজমা এসবের মালিকানার অধিকার থাকা উচিৎ না। যদিও নারীবাদী নামের অনেক মানুষ এসব অধিকারের কথা বলে বেড়ায়। কিন্তু নারীবাদ আমাকে শিখিয়েছে যে সম্পত্তির মালিকানার অধিকার কেবল পুরুষেরই জন্য। নারীকে এই অধিকার দেয়া আসলে নারীত্বের অপমান।

“আমি আগাগোড়া ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে খুব স্পষ্ট বিভাজন দরকার। কিন্ডারগার্টেনে ছবি আকার ক্লাসে আমি বাস্তিল দুর্গে হামলার ছবি আকতাম। কলেজে থাকতে ঠিক করেছিলাম আমার বাচ্চা হলে একজনের নাম দেব ভলতেয়ার, আরেকজনের রবসপিয়ের। আদর করে ডাকবো ভুলু-রুবু।

আমি বিশ্বাস করি দেশের ফৌজদারী আইন তাওরাত ও তালমুদের নিয়ম অনুযায়ী হওয়া উচিৎ। বর্তমানে যে বিধান আছে তা বাতিল করে সর্ব ক্ষেত্রে তাওরাত-তালমুদের বিধান জারি করা দরকার। ধর্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে আমি এটা বলছি না। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাই আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে। আমি ধর্মনিরপেক্ষ, আমি তাওরাতের বিধান চাই। এটাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কেউ কি ওপরের কথাটা বলতে পারে?

কোন নারীবাদী কি নারীদের “রাইট টু ঔনারশিপ”-এর বিরোধিতা করবে?

কোন সেক্যুলার কি রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে গ্রহণ করবে?

আরো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হল, এমন কাউকে কি আসলেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী’, ‘নারীবাদী’, কিংবা ‘ধর্মনিরপেক্ষ” বলা যাবে?

হ্যাঁ, এমন দাবি কেউ করতেই পারে। কিন্তু তাদের কথা তাদের সেই দাবির বৈধতাকে নাকচ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা নারীবাদের বিশ্বাস নিছক দাবির বিষয় না। এই আদর্শ/মতবাদগুলোর বিভিন্ন শর্ত, সীমারেখা, আবশ্যিকতা আছে। কিছু মৌলিক বিশ্বাস, সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং অবস্থান আছে – যা এই বিশ্বাস বা মতবাদগুলোর অনুসারীরা মেনে চলে। যদি কারো মধ্যে এগুলো না থাকে, তাহলে তাকে সেই আদর্শ/মতবাদের অনুসারী বলা যাবে না। সে নিজে যাই ইচ্ছে দাবি করুক না কেন। এধরণের মানুষকে তার দাবির ভিত্তিতে বিচার করা হবে না। সে যে আদর্শের কথা বলছে সেই আদর্শের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা হবে সে আসলেই ঐ আদর্শ ধারণ করে কি না।

এটুকু আমরা বুঝি। খুব সহজেই বুঝি। কিন্তু একই ধরনের দাবি যখন ইসলামের ক্ষেত্রে বলা হয়, তখন আমরা বুঝি না।

যেমন কেউ এক লাইনে বলছে, ‘আমি খুব বিশ্বাসী একজন মানুষ…’ আবার ঠিক তার পরের লাইনেই এমন কিছু বলছে যা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক।

যেমন,

“আমি ঘোরতর বিশ্বাসী মানুষ। আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। তবে এই স্ট্যাটাস লিখতে বসার আগেই বিশ রাকাত নফল নামায পড়ে আসলাম। আমি মনে করি –

সমকামিদের সমকামিতার অধিকার থাকা উচিৎ।

“পর্দাপ্রথা” আরবের মরুভূমির কালচার, এটা পালন করার প্রয়োজন নেই।

যৌন সম্পর্ক বৈধ এবং সঠিক হবার জন্য দুই পক্ষের সম্মতি থাকাই যথেষ্ট, আর কিছুর দরকার নেই।

কোন কাজকে হারাম, কুফর বলার অধিকার কারো নেই। ঔনলি গড কেন জাজ মি ব্রো।

ইসলামই আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে। এবং আমি এই বিশ্বাস নিয়েই সৃষ্টিকর্তার মুখোমুখি হবার আশা রাখি ইন শা আল্লাহ।

ও আচ্ছা জানেন তো, আমি কিন্তু গভীরভাবে বিশ্বাসী মানুষ…”

আজকাল এধরণের মানুষ করোনা রোগীর মতো বাড়ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সেলিব্রিটি আর ইনফ্লুয়েন্সারদের মধ্যে এই ধরণের ধার্মিকতা প্রমাণের প্রবণতা চোখে পড়ার মতো। অথচ এদের অবস্থান ওপরের চেতনাবাদী, নারীবাদী আর ‘ভুলুরুবুর আব্বা’র মতো। এই ধরণের লোকেরা মূলত একটা লিবারেল-সেক্যুলার মূল্যবোধ প্রচার করে। তাদের ওয়ার্ল্ডভিউ হল লিবারেল-সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউ। এরা বেইসিকালি বলতে চায় –

আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ আছেন। তিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতি, পদার্থ, অনুপরমাণূ, শক্তি, সবকিছুর নিয়ম তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। তাঁর বিধান নিখুত। সবকিছু তাঁর বিধান মেনে চলে। কিন্তু আমি মনে করি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তিনি যে বিধান দিয়েছেন তার চেয়ে ভালো বিধান মানুষ বানাতে পারে। তাঁর বিধান বাদ দিয়ে মানুষের বিধান মানা উচিৎ। আর যারা মানুষের বিধান না মেনে তাঁর বিধান মানতে চায় তারা উগ্রবাদী। ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী।

এই অবস্থান ইসলামের সাথে কতোটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেটা বুঝতে আলেম হওয়া লাগে না। নিজের সাথে সৎ হলেই হয়। গভীরভাবে বিশ্বাসী মুসলিম মনগড়া যুক্তি দিয়ে আর “আমি আমি…” করে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থান যাচাইয়ের জন্য ব্যস্ত হয় না। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবস্থান মেনে নেয়। আর নির্জলা যুক্তির জায়গা থেকে যে এমন অবস্থান অসংলগ্ন, সেটা সুস্থ বুদ্ধির যেকোন মানুষের কাছে স্পষ্ট।

কিন্তু এই স্বচ্ছতা তাদের মধ্যে নেই। তারা লিবারেল-সেক্যুলার মূল্যবোধ প্রচার করে, ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক বিভিন্ন অবস্থান প্রমোট করবে, আর তার আগে বিশ্বাসের সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে নেবে। ইসলামের জায়গা থেকে যখন তাদের প্রচারিত অবস্থানের বিরোধিতা করা হবে (ইসলামে সম লিঙ্গের মধ্যে যৌনতা ঘৃণ্য অপরাধ। অপরাধ করার কোন অধিকার হয় না) – তখন তারা *‘আমিও ধার্মিক’* কার্ডটা ব্যবহার করবে।

এই (কু)যুক্তি ব্যবহার করে তাদের প্রচারিত অবস্থানের বিপক্ষে সব ধরণের ধর্মীয় আপত্তিকে অবৈধ প্রমানের চেষ্টা করবে। আগেপরে দু’বার করে বলে নেবে – *”আমি যথেষ্ট জ্ঞান রাখি না… আমি আলেম না…”*।

কিন্তু ইসলামের অবস্থান থেকে যখন কেউ তাদের প্রচারিত লিবারেল অবস্থানগুলোর বিরোধিতা করে, তখন সেটাকে ‘উগ্রবাদ’, ‘অপব্যাখ্যা’ বলে চালিয়ে দেবে।

আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগে কড়াভাবে সেক্যুলারিসম আর লিবারেল মূল্যবোধ প্রচার করতো পাক্কা নাস্তিকরা। আজ একই কাজটা করে *‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাসী’* সাইনবোর্ড টানানো লিবারেল সেলিব্রিটিরা। প্রকাশ্য নাস্তিকরাও সেক্যুলার, এই লিবারেল মিশনারীরাও সেক্যুলার। কিন্তু এদের ক্ষতির মাত্রা এক না।

পাক্কা নাস্তিকরা বিভিন্ন ধরণের কূটকৌশল অবলম্বন করলেও, অ্যাটলিস্ট সরাসরি স্বীকার করতো যে তারা নাস্তিক। তারা ধর্মবিরোধী। তারা ইমানকে অপছন্দ করে। ইসলামকে ধ্বংস করতে চায়। সাধারণ মুসলিম তাদেরকে নাস্তিক হিসেবে চিনতো। কিন্তু আজকের লিবারেল মিশনারীরা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রশ্নে পাক্কা নাস্তিকদের মতো একই অবস্থান প্রচার করলেও, সেটা করে জোর গলায় নিজেদের বিশ্বাসী দাবি করে। আমি শক্তভাবে বিশ্বাস করি, গভীরভাবে বিশ্বাস করি ( নো পান ইন্টেন্ডেড) যে এই ধরণের লোকেরা প্রকাশ্য নাস্তিকদের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ পাক্কা নাস্তিকরা খোলাখুলি ইসলামকে আক্রমণ করতো। আর নতুন এই সেক্যুলাররা ইসলামের পরিচয় সামনে রেখে, ইমানকে আক্রমন করে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *