অনেক আঁধার পেরিয়ে


মুহাম্মাদ জাভেদ কায়সার ভাইকে বই লেখার কথা বলেছিলাম গত বছর। সম্ভবত বছরের এ সময়টাতেই। কিন্তু সরাসরি না করে দিলেন। মানুষের প্রশংসা ও মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আজ তাঁর অবর্তমানে তাঁর লেখাগুলো সংকলন ও সম্পাদনা করতে হল।

জাভেদ ভাই লিখেছেন প্রচুর। নানা বিষয়ে, নানা উপলক্ষে। এতো লেখার মধ্য থেকে কেবল একটা বইয়ের জন্য লেখা বাছাই করার কাজটা সহজ ছিল না। তবে আমার মনে হয়েছে তাঁর সব লেখালেখির মধ্যে অন্তর্নিহিত মূল সুরটা ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে বদলানোর। পাশাপাশি তাঁর লেখায় ফুটে উঠতো চারপাশের মানুষের ব্যাপারে দায়িত্ববোধ, তাদের ভুলগুলো সংশোধন করার, সৎ কাজে উৎসাহ, মন্দ কাজে বাধা দেয়ার সহজাত ইচ্ছে। অনেক আঁধার পেরিয়ে যে সত্যের খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন, তার আলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আন্তরিক আকাংক্ষা তাঁর মধ্যে কাজ করতো। এ অর্থে বলা যায় যে তাঁর সব লেখার মূল সূর ছিল পরিবর্তনের – নিজের চিন্তা, জীবন ও পারিপার্শ্বিকতাকে প্রতিনিয়ত আরো বেশি করে ইসলামের ছাঁচে সাজানোর।

পরিবর্তনের এ স্রোতের শক্ত উপস্থিতি ছিল মুহাম্মাদ জাভেদ কায়সারের জীবনেও। যারা তাঁকে চিনতেন; বাস্তব জীবনে কিংবা লেখালেখির মাধ্যমে, তারা জানেন যে তাঁর জীবনে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন এসেছিল, এবং এ পরিবর্তনের কারণ ছিল ইসলাম। কিংবা বলা যায়, ধর্ম ও ধর্মপালনের ব্যাপারে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও লোকজ চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে মূল উৎস থেকে যখন তিনি ইসলামকে জানতে শুরু করলেন, যখন চেষ্টা করলেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্মের মুসলিমদের উদাহরণ অনুযায়ী ইসলাম মানার – তখন তাঁর চিন্তা-চেতনা, জীবন ও জীবনদর্শন আমূল বদলে গেলো। তাঁর জীবনের মতোই এ পরিবর্তন প্রতিফলিত হল তাঁর লেখায়ও। জাভেদ কায়সারের লেখাগুলো একইসাথে তাঁর পরিবর্তনের অংশ এবং ফসল।

নিজেকে ভেঙ্গে আবার গড়ার এ অভিজ্ঞতা জাভেদ কায়সারের একার না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময় থেকে যুগেযুগে এধরনের পরিবর্তন হয়ে এসেছে। আজো আমাদের মাঝে এমন অনেক পরিবর্তনের গল্প আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে জাভেদ কায়সারের পরিবর্তনের গল্পটার কিছু বিশেষত্ব আছে, যে কারণে তাঁর লেখা নিয়ে এই আয়োজন। পরিবর্তনের আগে ও পরে তিনি সমান তালে লিখে গেছেন। যার ফলে অন্ধকার থেকে আলোতে ফেরার এ যাত্রার অনানুষ্ঠানিক এক ধরনের দিনলিপি তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। খুব কাছ থেকে পরিবর্তনের এ পথচলা দেখার একটি সুযোগ পাওয়া যায় তাঁর লেখা থেকে।

আরেকটি বিশেষত্ব হল তাঁর গল্পটা আমাদের সময়ের, আমাদেরই গল্প। আমাদের সামনে আজ সবদিক থেকে ক্রমাগত তুলে ধরা হয় জীবন ও সফলতার গৎবাঁধা এক সংজ্ঞা। এখানে মানব অস্তিত্বের সাফল্য মাপা হয় ডিগ্রি, চাকরি, স্যালারি, গাড়ি, বাড়ি, স্ট্যাটাস, ক্যারিয়ার, সামাজিকতা, প্রথা-প্রচলন, টাকা আর তাক লাগানোর এক যান্ত্রিক সমীকরণে। এ সংজ্ঞা, এ সমীকরণ প্রত্যাখ্যান করলে কপালে জোটে উন্মাদ, উগ্র কিংবা অবুঝ হবার অপবাদ। কিন্তু বহুল চর্চিত, চেনা, চকচকে এবং অন্তসারশুণ্য এ সংস্করণের বাইরেও যে সাফল্যের অন্য এক ব্যাখ্যা আছে, বেঁচে থাকার ভিন্ন পথ আছে তা আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। কিংবা কখনো চোখের সামনে চলে আসলেও তড়িঘড়ি করে আবার আমরা সেটাকে আড়ালে পাঠিয়ে দেই। আড়ালে থাকা কিংবা আড়াল করে রাখা সেই জীবনের কিছু ছবি, কিছু টুকরো টুকরো বর্ণনা পাঠক পাবেন পরিবর্তিত জাভেদ কায়সারের লেখাগুলোতে।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হল, এ গল্পের শেষটুকু আমাদের জানা। অসমাপ্ত কোন পথের অভিযাত্রীকে আমরা অনুসরণীয় হিসেবে উপস্থাপন করছি না। বরং আঁধার পেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখা মানুষদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক হিসেবে তাদেরই সময়ের, তাদেরই মত একজন মানুষের রূপান্তরের গল্পগুলো তুলে ধরছি। আল্লাহ চাইলে জাভেদ কায়সারের লেখাগুলো আরো অনেকের পরিবর্তনের উপলক্ষ হবে।

সম্পাদনার সময় লেখাগুলোকে অপরিবর্তিত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে হয়েছে। বইয়ের উপযোগী করে তোলার জন্য একই বিষয়ের বিভিন্ন ছোট ছোট লেখাকে আনা হয়েছে এক শিরোনামের অধীনে। বইয়ের সম্পাদনা এবং বিন্যাসের পুরো প্রক্রিয়ায় আমরা চেষ্টা করেছি লেখাগুলোকে এমনভাবে সাজাতে যাতে করে পরিবর্তনের পথে লেখকের যাত্রায় পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন লেখকের সহযাত্রী হিসেবে। এবং অনুভব করতে পারেন এ পথের সুখদুঃখ, চড়াই-উৎড়াইয়ের অভিজ্ঞতাগুলো।

এ বইয়ের পেছনে অনেক ভাইবোনের সময়, শ্রম ও আবেগ জড়িয়ে আছে। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রচেষ্টা কবুল করুন এবং তাঁদের উত্তম প্রতিদান দিন। বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি ভাইয়ের পরিবারকে যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল তাঁদের অন্তরগুলোকে প্রশান্ত করুন, উত্তম প্রতিদান দিন।

ইন শা আল্লাহ্ জাভেদ ভাই উত্তম অবস্থায় পৃথিবী ছেড়ে তাঁর মালিকের কাছে গেছেন। আল্লাহ্ আমাদের ভাইকে জান্নাত দান করুন, তাঁর ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ্ আর-রাহমানুর রাহীম তাঁর কবরকে জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দিন। আমরা আমাদের রবের ব্যাপারে সুধারণাই রাখি, আমরা আমাদের রবের কাছ থেকে সর্বোত্তমটাই আশা করি। আল্লাহ ভাইয়ের কাজগুলো তাঁর জন্য আমলে যারিয়াহ হিসেবে কবুল করুন। তাঁর কবরকে জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দিন।

মুহাম্মাদ জাভেদ কায়সারের গল্পের শেষটা আমরা জানি। কিন্তু আমাদের নিজেদের গল্পগুলো এখনো অসমাপ্ত। আমরা নিশ্চিতভাবে কেবল এটুকু জানি যে অবধারিতভাবেই একদিন আমাদের সবার গল্প শেষ হবে। ভয়ের ব্যাপারটা হল, শেষটা কেমন হবে তা আমাদের জানা নেই।

এ বই সংকলন ও প্রকাশের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য হল, পাঠককে একটি প্রশ্ন স্মরণ করিয়ে দেয়া। এমন একটি প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজে বের করা আমাদের প্রত্যেকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবীয় অগোছালো চিন্তার ঝঞ্ঝাটে তৈরি কোন প্রশ্ন না। সাত আসমানের ওপর থেকে আসমান ও যমীনের মালিকের পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া প্রশ্ন –

“মুমিনদের কি সময় হয়নি আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার?”

সব আনন্দ বিলুপ্তকারী মৃত্যুর মুখোমুখি হবার আগে এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আমাদের দিতে হবে। তার ওপরই নির্ভর করবে আমাদের নিজ নিজ গল্পগুলোর পরিসমাপ্তি। ছকে বাঁধা যান্ত্রিক জীবন আর অনুভূতিকে অবশ করে দেয়া ব্যস্ততা ও বিক্ষিপ্ততার মাঝে একটু কি সময় হবে আমাদের, প্রশ্নটি নিয়ে চিন্তা করার?

এখনো কি সময় হয়নি আল্লাহর স্মরণে অন্তরগুলো বিগলিত হবার?


আলহামদুলিল্লাহ, অনেক আঁধার পেরিয়ে বইটি এখন পাওয়া যাচ্ছে বাইতুল মুকাররাম মসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত ইসলামী বইমেলায়, Maktabatul Bayan মাকতাবাতুল বায়ান – এর স্টলে।

বইটি অনলাইনে অর্ডার করতে পারেন নিচের লিঙ্ক থেকে –

ওয়াফি – https://www.wafilife.com/shop/books/onek-adhar-periye/
রকমারি – https://www.rokomari.com/book/191556/onek-adhar-periye


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *