শুটকি ভাল, কিন্তু ঝাল ফ্রাই?


নিচের বক্তব্যটা পড়ে দেখুন –

“শুঁটকি খাওয়া একটা বিকৃত রুচির পরিচয়। প্রকৃতিতে কখনোই মাছ শুঁটকি অবস্থায় পাওয়া যায় না। কিছু মানুষ নিজেদের বিকৃত ক্ষুধা মেটাতে মাছকে জোর করে শুঁটকি বানায়। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? স্রষ্টার নিয়মের বিপক্ষে যাওয়া নয়? এছাড়া শুঁটকিতে এতো বাজে দুর্গন্ধ যে শুঁকলেই বমি আসে। চট্টগ্রামের কিছু হাফ-বার্মিজ বিকৃত রুচির মানুষ ছাড়া বাঙ্গালিরা এমনিতে শুটকি খায় না। শুটকিখোররা তাদের এই বিকৃতিকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তারা চায়, দেশের সবাই তাদের শুঁটকি খাওয়াটা স্বাভাবিকভাবে নিক। ৯০% বাঙালীদের বাংলাদেশে বার্মিজ সংস্কৃতির শুঁটকি খাওয়া চলবে না। সময় থাকতে এদের এইসব ষড়যন্ত্র দ্রুত রুখে দিতে হবে।”

কোন সমস্যা চোখে পড়ছে?

চাটগাইয়্যাদের হাফ-বার্মিয বলাটা স্পষ্টতই বইঙ্গা রেইসিসম। আর শুটকি শুধু চাটগাইয়্যারা না, সারা বাংলাদেশের অনেক জাতিগোষ্ঠীই খায়। এই দুটো পয়েন্ট ক্লিয়ারলি ভুল। এটা নিশ্চয় সবার চোখে পড়েছে। কিন্তু এর বাইরে অন্য কিছু? আমার চোখে ধরা পড়া একটা সমস্যা কথা বলি।

অনেকে ওপরের এই আরগুমেন্টটা “সমকামীতার” ডিফেন্সে ব্যবহার করছে। ওপরের প্যারাগ্রাফে “শুটকি”র বদলে “সমকামীতা” পড়লে নাকি “ধর্মান্ধ আর প্রতিক্রিয়াশীলদের সমকামীতা বিরোধিতার অসারতা” স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা। দেশী লিবারেলদের এমনই মত।

এই আরগুমেন্টে অনেকে বেশ কাবু হয়ে গেছেন। আসলেই তো! কেউ ভাজা মাছ পছন্দ করবে, কেউ শুটকি। কেউ আবার ঝোলঝোল করে রান্না করতে পছন্দ করে। কেউ ভ্যানিলা ফ্লেইভার পছন্দ করে, কেউ চকোলেট। সবার পছন্দ এক হবে না। কিন্তু তাই বলে কোন একটা পছন্দকে কি অপরাধ বলা যায়? কেউ পুরুষ হয়ে নারীর প্রতি আকর্ষনবোধ করে, কেউ পুরুষের প্রতি। পছন্দের এই পার্থক্য, রুচির এই তারতম্যের কারণে কি কাউকে অপরাধী বলা যায়?

জটিল সমস্যার মধ্যে জটিলতার আরেকটা স্তর যুক্ত করি। শুটকি মাছ নিয়ে এই বক্তব্য যেকোন ধরণের আচরণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। যেমন এই “যুক্তি” অপরিবর্তিতভাবে শিশুকামীতার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বাস না হলে, শুটকি মাছ খাওয়াকে “সমকামীতা” না ভেবে “শিশুকামীতা” ধরে নিয়ে আবারো ওপরের প্যারাগ্রাফটা পড়ুন। মানুষের ভিন্ন চুরি, ভিন্ন পছন্দ থাকতেই পারে। তাই বলে কি বৈচিত্র্যকে অপরাধ বলতে হবে নাকি? বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে শেখা উচিৎ। তাই না?

**আমি শিশুকামীতাকে পছন্দ করি না। কিন্তু আরেকজনের শিশুকামের অধিকারের জন্য আমি জীবন দিতে রাজি। জীবন দিতে আসলে রাজি না হলেও, কয়েকটা স্ট্যাটাস দিতে আর ভিডিও বানাতে তো অবশ্যই দিতে রাজি। আসুন শিশুকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হই? মানবিকতার খাতিরে। সত্য ও সুন্দরের জন্যে। **

এই অবস্থান কি দেশী লিবারেল আর প্রগতিশীলদের পছন্দ হবে?

হবে না। তারা তখন আপত্তি করবে। তাদের বক্তব্য না বোঝার কিংবা অপব্যাখ্যা করার অভিযোগ তুলবে। অথবা কনসেন্ট এবং হার্ম প্রিন্সিপালের কথা আনবে। হয়তো বলবে, সম লিঙ্গের মধ্যে যৌন সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হয়। এখানে কারো ক্ষতি হয় না। কিন্তু শিশুর সাথে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো অনুপস্থিত। “সম্মতি” এবং “ক্ষতির” ধারণা দিয়ে সমকামীতা এবং শিশুকামীতার মধ্যে পার্থক্য আদৌ দেখানো যায় কি না – সেটা আলাদা আলোচনা। সে আলোচনা হতে পারে।

কিন্তু আপনি যখনই ঐ আলোচনায় যাবেন তখন সেটা একটা নৈতিকতার প্রশ্ন হয়ে যাচ্ছে, এটুকু বুঝতে হবে। সেই নৈতিকতার আলোচনা হোক। দেশী প্রগতিশীল এবং লিবারেলরা নৈতিকতা বলতে আদৌ কী বোঝেন, তাদের নিজেদের বুঝকে তারা সর্বজনীন মনে করে কি না, সেটা তারা বলুক। “অধিকার”, “আধুনিক”, “প্রগতি”, “মানবতা”-র মতো বাযওয়ার্ডগুলো এক পাশে রেখে স্পষ্টভাবে নিজেদের নৈতিক মানদন্ড ব্যাখ্যা করুক। নৈতিকতার মানদন্ড কী হবে, কোন মানদন্ড সঠিক, কোন মানদন্ড উত্তম – সে আলোচনা হোক। কোন সমস্যা নেই।

কিন্তু এর বদলে আপনি যখন সম লিঙ্গের সাথে যৌন সম্পর্ককে শুটকি মাছ পছন্দ করার সাথে তুলনা করবেন তখন সেটা নৈতিকতার প্রশ্নকে আড়াল করবে। এটা শুধু নৈতিকতার প্রশ্নকে আড়াল করে না, বরং স্বভাবসুলভ লিবারেল উন্নাসিকতার জায়গা থেকে নৈতিকতার প্রশ্ন তোলাকেই তাচ্ছিল্য করবে। অথচ শুটকি মাছ পছন্দ করার যুক্তি দিয়ে যদি সমকামীতা সঠিক হয় তাহলে শিশুকামীতা এবং অজাচারও সঠিক হওয়া উচিৎ। কিন্তু দেশী লিবারেলরা এই অবস্থানগুলোকে সঠিক বলবে না। কারন তারা যৌক্তিকভাবে কনসিসটেন্ট না। তাদের অবস্থান অসংলগ্ন।

লিবারেল যুক্তিগুলো আওড়ে যাওয়া মানুষদের বড় একটা অংশ এসব কথার পেছনের ইতিহাস, দীর্ঘমেয়াদী ইমপ্লিকেইশান এবং তাৎপর্য্য সম্পর্কে বেখেয়াল। মিডিয়া এবং অ্যাকাডেমিয়া যে অবস্থানকে ‘মানবিক’, ‘উদার’, ‘নৈতিক’ হিসেবে যেসব অবস্থান তুলে ধরে, সেগুলো হুবহু কপি-পেইস্ট হয়ে বাঙ্গাল প্রগতিশীলিতা আর লিবারেলিসমের হ্যান্ডবুকে চলে আসে। ডমিনেন্ট কালচারাল ন্যারেটিভ দ্বারা তারা আগাগোড়া প্রভাবিত, যদিও তারা নিজেদের ‘কাউন্টারকালচার’ ভেবে মনে মনে সুখ পায়।

সমকামীতা এবং শিশুকামের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা অনেকের কাছে ভুল মনে হতে পারে। কেউ বলতে পারেন এটা এক ধরণের স্লিপারি স্লোপ আরগুমেন্ট। জুজুর ভয় দেখিয়ে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া। কিন্তু বাস্তবতা হল এখানে শিশুকামীতার প্রসঙ্গ আনা অমূলক না। অযৌক্তিকও না। সমকামী অধিকার আন্দোলন যেভাবে তাদের বক্তব্যকে ফ্রেইম করে। ঠিক একইভাবে শিশুকামের অধিকারের কথাও ফ্রেইম করা হয়। অধিকার, বৈচিত্র্য, মানবতা এবং সহিষ্ণুতার জায়গা থেকে সমকামীতা এবং শিশুকামীতা- দুটোর পক্ষেই যে অবস্থান নেয়া যায়, এটা আমার নিজের কথা না। হ্যারি হেই এর মতো সমকামী আন্দোলনের অনেক বড় নেতা, অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো আইকন এমন কথা বলেছে [১]। কুইয়ার থিওরি এবং কুইয়ার স্টাডিসের অনেক রথীমহারথী এই কথা বলেছে।

কুইয়ার স্টাডিসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন ধরা হয় গেইল রুবিনকে। ১৯৮৪ তে প্রকাশিত রুবিনের “থিংকিং সেক্স” প্রবন্ধকে কুইয়ার থিওরির ফাউন্ডিং টেক্সট বলা হয়ে থাকে। এই প্রবন্ধে সমকামীতা, স্যাইডোম্যাসোকিসম, ট্র্যান্সসেক্সুয়াল এবং শিশুকামসহ বিভিন্ন অবস্থানকে রুবিনকে একই কাতারে রেখেছে। শিশুকামীদের একটি নির্যাতিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। NAMBLA এর মতো পেডোফাইল প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করেছে। শিশুকামীতার বিরোধিতাকে সককামীতার বিরোধিতার সাথে, এবং চাইল্ড পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধকে আইনকে সমকামীতা বিরোধী আইনের সাথে তুলনা করেছে। শিশুকামকে “বয় লাভ”, “ক্রস জেনারেশানাল কিংবা ইন্টার জেনারেশানাল যৌনতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে [২]।

আরেক মহারথী কুইয়ার থিওরিস্ট প্যাট ক্যালিফিয়ার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ডাচ পেডোফাইল ম্যাগাযিন ‘পাইডিকা’তে [৩]। এই প্রবন্ধে ক্যালিফিয়া দাবি করে “সমকামবিদ্বেষের” (হোমোফোবিয়া) শিশুদের পর্নোগ্রাফিক ইমেজ এবং ভিডিওকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে [৪]।

এমনকি কুইয়ার থিওরির “গডফাদার” মিশেল ফুকো-ও সমকামীতা এবং শিশুকামীতাকে (এবং সম্ভাব্য সব ধরণের যৌন বিকৃতি) একই কাতারে রেখেছিল। ফুকো আরো বলেছিল শিশুরা যৌন সম্পর্কের সাথে “সম্মতি” জানাতে পারে, এবং শিশুর যৌনজগতে প্রাপ্তবয়স্করা প্রবেশ করতে পারবে না, এই ধরণের ধারনা প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ [৫][৬][৭]। কাজেই সমকামীতা এবং শিশুকামীতার (এবং অন্যান্য যৌন বিকৃতির) মধ্যে সম্পর্ক আছে বলেই সেটা কুইয়ার থিওরিস্ট, সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট এবং লিবারেল এথিসিস্টদের কথাতে উঠে এসেছে। এখানে কোন কাল্পনিক সম্পর্ক আবিষ্কার করা হচ্ছে না।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, শিশুকামীতাসহ বিভিন্ন যৌন বিকৃতির প্রতি আকর্ষনকে গেইল রুবিনের ঝাল খাবার পছন্দ করার সাথে তুলনা করে বলেছিল – খাবারে একটু ঝাল পছন্দ করাকে অনৈতিক মনে করা হয় না। কেউ বেশি ঝাল খেলে তাকে জেলে পাঠানো হয় না। কিংবা পরিবার ও সমাজ থেকে বিতাড়িত হয় না।

তাহলে যৌনতার ব্যাপারে এতো কঠোরতা কেন?

প্রশ্ন হল, দেশীয় লিবারেলরা কি শুধু শুটকি নিয়েই কথা বলবেন নাকি ঝাল ফ্রাই নিয়েও কথা হবে? শুটকির আলোচনা যে অবধারিতভাবে ঝাল ফ্রাইয়ের দিকে যাবে যেমনটা পশ্চিমে গেছে, সেটা কি স্বীকার করা হবে?

নাকি হাতসাফাই আর আবেগী রেটোরিক বাদ দিয়ে সরাসরি নৈতিকতা আর মানদন্ডের প্রশ্নে আসা হবে?

[১] https://tinyurl.com/yd7x5ngx

[২] Thinking Sex: Notes for a Radical Theory of the Politics of Sexuality, G. S. Rubin (১৯৮৪)

[৩] Feminism, Pedophilia, and Children’s Rights, Pat Califia, (1991)

[৪] প্রাগুক্ত

[৫] French petition against age of consent laws

[৬] Queer Theory, Foucauldian Feminism and the Erasure of Rape, J C Jones

[৭] “La Loi de la pudeur ( The Danger of Child Sexuality), M Foucault, G Hocquenghem, J Danet (1978)


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *