চিন্তার গোলধাঁধা ১ – স্বাধীনতা


আমরা সবাই ইসলামের বিজয় চাই। কিন্তু বিজয় কিভাবে, কোন পথে হবে, কেমন হবে এ পথচলা–তা নিয়ে খুব একটা ভাবি না। অল্পস্বল্প যখন ভাবি তখনও সেটা খুব একটা যৌক্তিক বা গোছানো হয় না।

আমাদের ভাবনাগুলো আটকে থাকে, আবেগ, কিছুটা ক্রোধ আর ঢালাও কিছু মূলনীতির কাঠামোর ভেতরে। ফলে আমাদের চিন্তা বেশিরভাগ সময় হয় বাস্তবতাবিবর্জিত এবং অনেকটা কল্পনা নির্ভর।

এর অন্যতম কারন হল মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস এবং বাস্তবতা সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা। ধারণাগুলো ভুল হলেও দীর্ঘদিনের প্রচারের ফলে বেশ ভালোভাবেই শেকড় গেড়ে বসেছে মানুষের মনে।  ইসলামী শাসন এবং উম্মাহর পুনর্জাগরণ নিয়ে আমাদের চিন্তা হোঁচট খাচ্ছে বারবার। আটকে যাচ্ছে গোলকধাঁধায়। এই পপুলার মিথগুলো ভাঙ্গা দরকার। তা না হলে, গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়া যাবে না।

এমন একটা মিথ হল, ‘স্বাধীনতা’।
আমাদের অনেকেদের মধ্যে একটা ধারণা আছে, আমরা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হয়েছি। এ ধারণা পুরোপুরি ভুল। ইউরোপীয় শক্তিগুলো এখনআমাদের সামরিকভাবে দখল করে নেই, এ কথা সত্য। কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা স্বাধীন।

পশ্চিমা দখলদারদের নিয়ন্ত্রন বন্ধ হয়নি, কেবল নিয়ন্ত্রনের চেহারা বদলেছে। সরাসরি সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রনের বদলে ইউরোপীয় সভ্যতা এখন নিয়ন্ত্রন করছে পরোক্ষভাবে। ঔপনিবেশিক শাসন এখনো চলছে। পার্থক্য হল, সাদা চামড়া বদলে এখন শাসন চালাচ্ছে বাদামী চামড়ার লোকেরা।

ভেবে দেখুন। মুসলিম ভূখণ্ডগুলো এখন যে ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় সেটা একটা নিরেট ইউরোপীয়, সেক্যুলার ব্যবস্থা। এর সাথে ইসলাম এবং মুসলিমদের ঐতিহাসিক কোন সম্পর্ক নেই। ইউরোপীয় দখলদাররা এ ব্যবস্থা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

আমাদের সংবিধানগুলো গড়ে উঠেছে তাদের অনুকরণে। আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থার মূল কাঠামোও তাদের বানানো। মুসলিম বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলো কলোনিয়াল সেনাবাহিনীর আদলে তৈরি। তাদের হাতে প্রশিক্ষিত। এবং আজো তাদের বিভিন্ন জোটের ভাড়াটে সৈন্য।

কথাটা শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। মুসলিম দেশগুলো সেনাবাহিনীগুলো মুসলিমদের জন্য লড়াই করে না। তারা লড়াই করে পশ্চিমা সভ্যতার একাধিপত্য এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে।

কখনো কি শুনেছেন অমুক অঞ্চলের নির্যাতিত মুসলিমদের রক্ষার জন্য কোন মুসলিম দেশের সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছে? না, শোনেননি।

কিন্তু জাতিসংঘ, ন্যাটোর অংশ হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম দেশের সেনাবাহিনীগুলো ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে।

কখনো শুনেছেন, কোন মুসলিম দেশের সেনাবাহিনী ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছে? অবশ্যই না। কিন্তু গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ?

হরহামেশা চলছে।

আমাদের রাজনীতি, মিডিয়া, শিক্ষাব্যবস্থা – সবগুলোর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

প্রতিটা ক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল ইউরোপীয়দের তৈরি করা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। তাদের দর্শন, তাদের আদর্শ মুখস্থ করা। তাদের আচার-আচরণ, পোশাক অনুকরণ করতে শেখা।

আজকের ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রগুলো ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছুই না।

এক সময় মুসলিম ভূখণ্ডগুলো ইসলামী শরীয়াহ দিয়ে শাসিত হত। শাসকদের এবং জনগণের মধ্যে ভুলত্রুটি ছিল। যুলুম ছিল, অনেক ক্ষেত্রে শরীয়াহর লঙ্ঘন ছিল। কিন্তু মূল কাঠামো ছিল ইসলামী। শাসক এবং জনগণের আনুগত্য ছিল ইসলামের প্রতি।

ইউরোপীয়রা এসে এই শাসনব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। তারপর সেখানে বসিয়েছে নিজেদের বানানো ব্যবস্থা।

আজ তারা চলে গেছে, কিন্তু আমরা আগাগোড়া তাদের ব্যবস্থা আকড়ে ধরে আছি। তাদের মতবাদগুলো শিখছি, শেখাচ্ছি, বাস্তবায়ন করছি। এমনকি যুদ্ধও করছি তাদের জন্য।

এটা কেমন ধরণের স্বাধীনতা?

আমরা স্বাধীন না। আমরা পরাধীন। মুসলিম উম্মাহর কোন নিজস্ব রাষ্ট্র নেই, সেনাবাহিনী নেই, সরকার নেই। আমরা কিছু নব্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনস্ত। যে কাঠামো একদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ন্ত্রন করতে চায়। অন্যদিকে যেকোন মূল্যে টিকিয়ে রাখতে চায় পশ্চিমা সভ্যতার হেজেমনি।

তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং উম্মাহর পুনর্জাগরনের যেকোন প্রচেষ্টার সামনে প্রথমে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে এ কাঠামোই। একসময় ফিরিঙ্গি কলোনিয়াল শাসকরা যা করেছিল, বাদামী চামড়াওয়ালাদের চালানো আধুনিক ‘মুসলিম’ রাষ্ট্রগুলো দেশে দেশে তাই করবে এবং করছে। কারণ দুটো এক, অভিন্ন।

সত্যটা না চিনে স্বাধীনতার মিথ আকড়ে ধরে থাকলে- বাস্তবতাকে বোঝা এবং পরিবর্তন করা সম্ভব না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *