রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী?


‘রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী?’ এ প্রশ্নের একটা কাউন্টার পড়েছিলাম কোথাও,

‘রাষ্ট্রের আবার ভাষা কী?’

প্রথম দেখায় এটাকে বেশ জুতসই একটা জবাব মনে হয়। কিন্তু একটু ভালো করে তাকালে সমস্যা ধরা পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বলে যে জিনিসটাকে বোঝানো হয়, সেটার আসলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আছে। রাষ্ট্রভাষার আরেক নাম হল দাপ্তরিক ভাষা। দেশের সংসদ, আদালতসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাজে যে ভাষার ব্যবহার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সেটাই রাষ্ট্রভাষা।

এ হিসেবে ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ থাকা জরুরী।

কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারটা কেমন? বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রে?

কেতাবি চালে বলা যায়, রাষ্ট্রধর্ম হল এমন কোন ধর্মীয় অবস্থান বা বিশ্বাস যা রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক ও সরকারীভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করে।

অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সেক্যুলার রাষ্ট্রে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলাম দাবি করা একটা অক্সিমোরন। দুটি পারস্পরিক সাংঘর্ষিক এবং বিপরীতমুখী ধারণাকে জোর করে মেলানোর চেষ্টা।

শাসন, সার্বভৌমত্ব, আইন প্রণয়ন, বিচার, প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ইসলামকে হটিয়ে দিয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সেক্যুলার রাষ্ট্র অগণিত বিষয়ে সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি ইসলামের যে অবস্থান সেটাকে ‘অবৈধ’ কিংবা ‘বেআইনি’ সাব্যস্ত করে। সেক্যুলার রাষ্ট্র বাই ডিফল্ট ধর্মহীনতার অবস্থান থেকে কাজ করে। এমন রাষ্ট্রের ঘোষিত আদর্শ, মূল্যবোধ, আইন, কোন কিছুর সাথে ইসলামের দূরতম কোন সম্পর্ক থাকে না।

এমন একটা সেটআপের সামনে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলাম লাগিয়ে রাখা কার্যত অর্থহীন। তার ওপর যদি কোন রাষ্ট্রের সংবিধানে স্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয় তাহলে রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টা তাত্ত্বিক এবং শাব্দিকভাবে অর্থহীন হয়ে যায়। যেমন কোন দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা। এর অর্থ কী? কার্যত কিংবা শাব্দিক কোন দিক থেকেই এর কোন সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থ হয় না।

সেক্যুলার রাষ্ট্রের সামনে এই ধরণের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখার আসলে একটা কৌশল। মুসলিমরা যেন ইসলামী শাসন না চায়, তা নিশ্চিত করার জন্য কোনরকম বুঝ দিয়ে রাখা। বাংলাদেশের সেক্যুলাররা ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিষয়টাকে রাষ্ট্রের ‘ইসলামীকরণে’-এর উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু আদতে এটা সেক্যুলারায়নের বেশ কার্যকরী একটা পদ্ধতি।

হুট করে ইসলামকে সরিয়ে দেয়া হলে জনমতের ওপর সেটার প্রভাব নেতিবাচক। এক্ষেত্রে ইসলামের অবস্থান থেকে শাসক ও শাসনের বৈধতা নিয়ে চিন্তা শুরু হবার ঝুঁকিটাও থেকে যায়। অন্যদিকে অলঙ্কারিক রাষ্ট্রধর্মকে মূলোর মতো ঝুলিয়ে নির্বিঘ্নে এগিয়ে নেয়া যায় সেক্যূলার প্রজেক্টকে। এবং বাস্তবে তাই হয়, হয়ে আসছে।

এমন একটা বাস্তবতায় রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেয়া হবে নাকি হবে না – সেই প্রশ্ন আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। কারণ দু ক্ষেত্রেই মূল গতিপথ এক ও অভিন্ন, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির আরো বেশি সেক্যুলারায়ন। পার্থক্য সামান্য এবং সেটা অ্যাপ্রোচে, মৌলিক কিছু না।

‘যা আছে তা অন্তত রক্ষা করি’; এ মনোভাবে থেকে কেউ কোন নির্দিষ্ট ঘটনার বিরোধিতা করতেই পারেন। কিন্তু কারো পুরো চিন্তা, দর্শন, কর্মকান্ড যদি কেবল এসব মৌসুমী ‘আন্দোলন’-কেন্দ্রিক হয়, যদি রাজনীতির অর্থ হয় কেবল এমন ইস্যুতে অস্তিত্ব জানান দেয়া, তাহলে সেটা একধরণের ইন্টারনালাইযড সেক্যুলারিসম।

ব্যাপারটা অনেকটা উৎসাহ-আয়োজন নিয়ে বারবার পাতানো জুয়ায় হেরে যাওয়া, তারপর চেচামেচি করা, তারপর ‘পরেরবার জিতবো, বলার মতো। এই অ্যাপ্রোচ সমাধান তো আনেই না, বরং সমস্যাকে জিইয়ে রাখে, আরো প্রকট করে, এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকেও এই পাতানো জুয়ায় আবদ্ধ ও আসক্ত করে ফেলে।

তার ওপর এই অলঙ্কারকে পুঁজি করে কেউ যদি সেক্যুলার রাষ্ট্র ও শাসন বৈধতা দেয়, তাহলে তখন ব্যাপারটা আরো গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়। .ইসলামের অবস্থান থেকে আমাদের উচিৎ সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা, ইসলামী শাসনের কথা বলা, সাধারণ মুসলিমদের সচেতন করা, জনমত তৈরি করা এবং এই দাবি এবং একে প্রতিষ্ঠা করার মতো ক্ষমতা তৈরি করা। সেক্যুলারিযমের মূর্তি ভাঙ্গতে না পারলে কমপক্ষে মূর্তি যে ভাঙ্গতে হবে সেই বোধ ও চিন্তা তৈরি করা। সেক্যুলার রাষ্ট্র কতোটুকু ইসলামকে বৈধতা দেবে সেটা আমাদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিৎ না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *